কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
আশি বছর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রহরে, রুশ বালক-স্কাউটদের একটি দল মস্কোয় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে উপহার দেয় কাঠে খোদাই করা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সিল (Great Seal)। যুদ্ধকালীন রাশিয়া-মার্কিন মিত্রতার প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রদূত ডব্লিউ অ্যাভেরেল হ্যারিম্যান গর্বের সঙ্গে এটি তার সরকারি বাসভবন স্পাসো হাউস-এ টাঙিয়ে রাখেন।
কিন্তু তিনি বা তার নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কেউই বুঝতে পারেননি—এই কাঠখোদাইয়ের ভেতরে লুকানো আছে এক গুপ্ত শোনার যন্ত্র, যা পরে মার্কিন প্রযুক্তি নিরাপত্তা দল নাম দেয় “দ্য থিং”। পুরো সাত বছর ধরে অদৃশ্য এই কান রাষ্ট্রদূতের গোপন বৈঠকের আলাপচারিতা শুনতে থাকল। এভাবে, একেবারে নির্দোষ শিল্পকর্মের আড়ালে প্রতিপক্ষের ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে সোভিয়েতরা কৌশলে অর্জন করেছিল এক বিরাট গুপ্তচরবৃত্তির সাফল্য। যেন আধুনিক যুগের ট্রোজান হর্স—কিন্তু ঘটনাটি একেবারে বাস্তব।
কিভাবে কাজ করত “দ্য থিং”?
কাউন্টার-সার্ভেইলেন্স বিশেষজ্ঞ জন লিটল (৭৯), যিনি এর প্রযুক্তি নিয়ে বহু বছর গবেষণা করেছেন এবং নিজের হাতে একটি প্রতিলিপিও বানিয়েছেন, এটিকে ব্যাখ্যা করেন সঙ্গীতের ভাষায়। এর গঠন ছিল অর্গান পাইপের মতো টিউব আর ঢাকের মতো কম্পমান ঝিল্লি দিয়ে, যা মানব কণ্ঠের শব্দে কেঁপে উঠত। অথচ পুরো জিনিসটা ছিল টুপির কাঁটার মতো ছোট।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—এতে কোনো ব্যাটারি বা ইলেকট্রনিক সার্কিট ছিল না, এমনকি গরমও হত না, তাই সাধারণ স্ক্যানারে ধরা পড়ত না। লিটলের ভাষায়, “এটা যেন সুইস ঘড়ি আর মাইক্রোমিটারের মিশ্রণ।”
এটি সক্রিয় হত কেবল তখনই, যখন কাছাকাছি একটি ভবন থেকে সোভিয়েতরা উচ্চ-তরঙ্গের সিগনাল পাঠাত। তখন সেই সিগনাল ফিরে আসত যন্ত্রের অ্যান্টেনা থেকে, সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের ঘরের গোপন আলাপচারিতার কম্পনও।
১৯৫১ সালে এক ব্রিটিশ সামরিক রেডিও অপারেটর দুর্ঘটনাক্রমে সঠিক তরঙ্গে টিউন করতে গিয়ে হঠাৎ শুনে ফেলেন দূরের কক্ষের আলোচনা। এরপর ১৯৫২ সালে মার্কিন নিরাপত্তা দল তিন দিন ধরে পুরো বাসভবন তল্লাশি করে অবশেষে খুঁজে পায়—গ্রেট সিলটি আসলে এক অদৃশ্য কান।
শিল্প ও গুপ্তচরবৃত্তি
“দ্য থিং”-এর সফলতা কেবল প্রযুক্তিগত নৈপুণ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মূল কৌশল ছিল সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বের সুযোগ নেওয়া। মানুষ শিল্পকর্মকে নিরীহ, মর্যাদা ও রুচির প্রতীক হিসেবে দেখে—সোভিয়েত গোয়েন্দারা সেটিকে অস্ত্র বানাল।
এমন উদাহরণ ইতিহাসে আরও আছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যেমন শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধযন্ত্র তৈরি করেছিলেন, পিটার পল রুবেন্স ত্রিশ বছরের যুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বহু শিল্পী নকশা করেছিলেন ছদ্মবেশ ও বিভ্রান্তিমূলক সামরিক কৌশল। এমনকি অ্যান্থনি ব্লান্ট, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ রাজকীয় শিল্পসংগ্রহের তত্ত্বাবধায়ক, তিনি-ও সোভিয়েত গুপ্তচর ছিলেন।
উদ্ভাবক থেরেমিন
“দ্য থিং”-এর আবিষ্কারক ছিলেন লেভ সের্গেইভিচ থেরেমিন (লিয়ন থেরেমিন নামে পরিচিত)—রুশ উদ্ভাবক ও সংগীতজ্ঞ। তিনিই তৈরি করেছিলেন বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র থেরেমিন, যা ছোঁয়া ছাড়াই বাজানো যায়। ১৯৫০-এর দশকে সায়েন্স ফিকশন সিনেমার ভূতুড়ে সুরের জন্য এই যন্ত্র বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
গোপন থেকে প্রকাশ্যে
আবিষ্কারের পর দীর্ঘদিন মার্কিন গোয়েন্দারা বিষয়টি গোপন রাখে। কিন্তু ১৯৬০ সালে সোভিয়েতরা একটি মার্কিন U-2 স্পাই প্লেন গুলি করে নামালে, কূটনৈতিক সঙ্কটের মুখে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্যে তুলে ধরে এই গ্রেট সিল। এতে প্রমাণ করা যায়—গুপ্তচরবৃত্তি শুধু একপক্ষীয় ছিল না।
ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এর নাম দেয় SATYR এবং গোপনে বহু বছর ধরে বিশ্লেষণ চালায়। ১৯৮৭ সালে প্রাক্তন নিরাপত্তা কর্মকর্তা পিটার রাইট তার আত্মজীবনী Spycatcher-এ প্রথম বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন।
আজও “দ্য থিং” ইতিহাসবিদদের মুগ্ধ করে রেখেছে। কারণ এটি ছিল সময়ের তুলনায় অবিশ্বাস্যভাবে উন্নত প্রযুক্তি, যা ঠান্ডা যুদ্ধের গুপ্তচরবৃত্তিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। এটি একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয়—শিল্পকলা শুধু অপেরা বা গ্যালারির রঙিন জগতেই সীমাবদ্ধ নয়; অনেক সময় কাঠখোদাই করা প্রতীক বা সুরস্রষ্টার উদ্ভাবনও হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা যুদ্ধের অস্ত্র।
সূত্র: বিবিসি