কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। তাঁর জন্ম ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫ সালে, যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার নান্দুয়ালী গ্রামে। শিল্পচর্চা, পুতুলনাট্য, এবং শিক্ষায় তার অবদান শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রশংসিত।
মুস্তাফা মনোয়ারের জীবন:
মুস্তাফা মনোয়ারের শৈশব কেটেছিল বই, প্রকৃতি এবং সৃজনশীলতাকে ঘিরে। তাঁর বাবা ড. মুহম্মদ এনামুল হক ছিলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত, সাহিত্যিক ও গবেষক। বাবার সান্নিধ্যে ছোটবেলা থেকেই মুস্তাফা মনোয়ারের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জন্মে।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং নিজেকে আরও পরিপূর্ণভাবে গড়তে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এখান থেকেই তাঁর শিল্পচর্চার দিগন্ত প্রসারিত হয়।
মুস্তাফা মনোয়ারের চিত্রকর্মে অবদান:
মুস্তাফা মনোয়ারের চিত্রকর্মে প্রকৃতি, মানবিকতা, এবং দেশীয় ঐতিহ্যের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাঁর তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনধারা, প্রকৃতির রূপমাধুর্য এবং মানুষের অন্তর্গত আবেগ। তাঁর চিত্রকর্মে বিশেষ করে জলরঙের ব্যবহার অত্যন্ত প্রশংসিত। জলরঙে তিনি এমন দক্ষতা অর্জন করেন, যা সহজে অন্য কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাঁর চিত্রকর্মে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি যেমন নদী, নৌকা, গ্রামীণ জীবন বা সবুজ বাংলার সৌন্দর্য অসাধারণভাবে ফুটে ওঠে।
পুতুলনাট্যের অগ্রদূত:
মুস্তাফা মনোয়ার বাংলাদেশের পুতুলনাট্য আন্দোলনের অগ্রদূত। দেশীয় সংস্কৃতির এই প্রাচীন ধারাকে আধুনিক রূপ দিয়ে তিনি নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তাঁর পুতুলনাট্য শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অনন্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ১৯৭০-এর দশকে পুতুলনাট্যের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। তাঁর তৈরি পুতুলনাট্যগুলো যেমন শিক্ষণীয়, তেমনই বিনোদনমূলক।
মুস্তাফা মনোয়ারের শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান:
মুস্তাফা মনোয়ার শুধু শিল্পচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি শিক্ষাক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে বিটিভি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ও মননশীল অনুষ্ঠান নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুতুলনাট্য ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যা শিশুদের সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তি প্রসারে সহায়তা করে। তাঁর কাজগুলোর মধ্যে দেশপ্রেম এবং মানবিক মূল্যবোধের বার্তা স্পষ্ট।
মুস্তাফা মনোয়ারের স্বীকৃতি:
তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য মুস্তাফা মনোয়ার পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে, যা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান। তিনি আন্তর্জাতিক পরিসরেও সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর শিল্পকর্ম এবং পুতুলনাট্য বহু আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে প্রশংসিত হয়েছে।
শিল্প-সংস্কৃতির একজন পথিকৃৎ:
বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার কেবল একজন চিত্রশিল্পী বা পুতুলনাট্যকার নন, তিনি বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির একজন পথিকৃৎ। তাঁর সৃজনশীলতা, চিন্তাভাবনা এবং কাজের মাধ্যমে তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন। জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ড তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।