কালচরাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
২০০৬ সালের কথা। অনুরাগ বসুর চলচ্চিত্র গ্যাংস্টার মুক্তি পায়। ছবির সাফল্য ছিল গড়পড়তা, কিন্তু এর গান “ইয়া আলি” মুহূর্তেই ঝড় তোলে। কলেজ ক্যান্টিন, হোস্টেল আড্ডা, ক্যাসেটের দোকান— সর্বত্র বাজতে থাকে গানটি। সেই সুরের পেছনের কণ্ঠ একেবারে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। প্রজন্মের স্বপ্ন, প্রেম, বেদনা, উচ্ছ্বাস— সবকিছুর সঙ্গে মিশে যায় এই কণ্ঠ। আর তিনি হলেন— জুবিন গার্গ।
প্রায় দুই দশক পর হঠাৎই থেমে গেল সেই কণ্ঠস্বর। সিঙ্গাপুরে সাঁতার কাটার সময় খিঁচুনি ওঠায় ডুবে মারা যান আসামের এই প্রিয় শিল্পী। তাঁর মৃত্যু শুধু একটি শিল্পীর বিদায় নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক যুগের অবসান।
২১ সেপ্টেম্বর রবিবার সকালে গুয়াহাটি বিমানবন্দর থেকে কাহিলিপাড়ার বাড়ি পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পথ হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। ফুলে সাজানো অ্যাম্বুলেন্স ধীরগতিতে এগোয়, পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে গন্তব্যে পৌঁছতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল হাজারো মানুষ— বয়স্ক থেকে শিশু, নারী থেকে তরুণ, এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও। কেউ ফুল ছিটিয়েছেন, কেউ হাত জোড় করে প্রার্থনা করেছেন, কেউ কেবল নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছেন।
গুয়াহাটির সাংবাদিক অনিতা গোস্বামী বলেন,
“শহরজুড়ে এমন নীরবতা, এমন ঐক্য আমি আগে কখনো দেখিনি। মহামারির সময়কার মতো নিস্তব্ধ ও গুমোট পরিবেশ। সবাই যেন একসঙ্গে শোকে ডুবে আছেন।”
রাস্তার দুই ধারে বারান্দা, ছাদ, রোড ডিভাইডার পর্যন্ত ভরে যায় মানুষে। শবযাত্রার সঙ্গে ছিলেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। শেষমেশ বাড়িতে পৌঁছালে পরিবারের জন্য ব্যক্তিগত বিদায়ের সময় রাখা হয়। কাচের কফিনে শোয়ানো ছিল জুবিন গার্গের দেহ, আসামি গামোছায় মোড়া।
গুয়াহাটির দৈনন্দিন জীবন যেন থমকে গেল। দোকানপাট, বাজার, রেস্তোরাঁ— সব বন্ধ। ফুড ডেলিভারি, অনলাইন পরিষেবাও অচল হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি ও অসুবিধা।
এক ডিজিটাল শিল্পী রূপম মুদোই বলেন,
“মানুষের আবেগ এতটাই প্রবল ছিল যে, দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীলরাও দোকান খুলতে পারেননি। অনেকে ভক্ত সংগঠনের চাপে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। শ্রদ্ধা দেখানো উচিত হৃদয় থেকে, কিন্তু আবেগ এতটাই তীব্র ছিল যে যুক্তি বা বাস্তবতা আর জায়গা পায়নি।”
তিন দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জুবিন গেয়েছেন প্রায় ৩৮ হাজার গান, ৪০টি ভাষা ও উপভাষায়। দেশীয় সঙ্গীত থেকে বলিউড— সর্বত্র তিনি নিজের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন আসামের গর্ব, সংস্কৃতির দূত।
দিল্লি বিমানবন্দরে তাঁর কফিন গ্রহণ করেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী পবিত্র মার্গেরিটা। গুয়াহাটিতে মরদেহ আসার পর স্ত্রী গারিমা সাইকিয়া গার্গ ভেঙে পড়েন, স্বামীর কফিন আঁকড়ে ধরে গামোছা দিয়ে ঢেকে দেন। উপস্থিত সকলেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
শবযাত্রায় তাঁর প্রিয় ওপেন জিপ ছিল, সঙ্গে ব্যান্ডসদস্যরা। ভক্তরা গাইছিলেন তাঁর গান, হাতে পোস্টার ও কাটাে আকার, আর গামোছায় লেখা ছিল “ZG Forever”। অনেকেই বাজাচ্ছিলেন তাঁর প্রিয় গান “মায়াবিনী”— মৃত্যুর পর বাজানোর ইচ্ছা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।
সরকার এখনো শেষকৃত্যের স্থান নির্ধারণ করেনি। সম্ভাব্য জায়গা হিসেবে সোনাপুরের নাম উঠে আসছে। অন্যদিকে অনেকে চান তাঁর শেষকৃত্য জোরহাটে হোক, যেখানে তিনি জীবনের বহু সময় কাটিয়েছেন। তবে তাঁর বৃদ্ধ পিতার যাতায়াতের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা অনিতা গোস্বামী বলেন,
“জুবিন দা কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি আমাদের পরিবারের অংশ। তাঁর মৃত্যুতে আমরা যেন নিজেদেরই কাউকে হারালাম।”
ইঞ্জিনিয়ার মিমলি বরদোলইয়ের কথায়,
“আসাম আজ এক সত্যিকারের রত্ন হারাল। তাঁর মতো আর কেউ আসবেন না।”
জুবিন গার্গ ছিলেন না শুধুই এক জন গায়ক— তিনি ছিলেন আসামের প্রাণ, সংস্কৃতির রঙ। তাঁর কণ্ঠ ছিল মানুষের আবেগ, মানুষের প্রতিবাদ, মানুষের ভালোবাসা। আজ তিনি নেই, তবু তাঁর গান, তাঁর স্মৃতি আর মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে থাকা আবেগ তাঁকে চিরজীবী করে রাখবে।
আসামের মানুষ আজ শোকে নিমজ্জিত, কিন্তু তাঁদের শোকের ভেতর দিয়েই স্পষ্ট হয়ে উঠছে— জুবিন গার্গ আসলে একজন শিল্পী নন, তিনি এক যুগের প্রতীক।