বিশেষ প্রতিবেদক:
‘আমি এক মাতাল। ভাঙা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল’। বাঙালীর জন্য সিনেমা নির্মাণ করতেন। কিন্তু তার ছবি স্থুল বিনোদন না। তার ভাষ্যে- ‘আমি প্রতি মুহুর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি।’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি বোধের জায়গা করে দিতেন ঋত্বিক কুমারঘটক।
তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী চলচ্চিত্রকার। ছিলেন নাট্যকার, লেখক ও অভিনেতা। তাঁর লেখায়, তাঁর নির্দেশনায়, তাঁর অভিনয়ে প্রতিবাদই ছিলো প্রধান। এক হাতে জ্বলন্ত পাতার বিড়ি আরেক হাতে বাংলা মদের বোতল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন জীর্ণ শীর্ণ রোগা পাতলা এই মানুষটি। পরণে থাকতো পুরনো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। এলোমেলো চুলের সঙ্গে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ঝুলতো ঝোলা। যেই ঝোলায় তিনি ফেরি করতেন শিল্পমাখা হাজারও স্বপ্ন।
“ঋত্বিক ইজ আ গ্রেট মাস্টার অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা। ভারতের সিনেমায় যা কিছু হয়েছে, ঋত্বিক ঘটক তার থেকে অন্তত দশ বছর এগিয়ে ছিলেন।” নবারুণ ভট্টাচার্যের এই উক্তি যেন কেবল প্রশংসা নয়—এটা সময়েরও এক আত্মস্বীকৃতি। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এমন পরিচালক খুব বেশি নেই, যাঁদের শিল্পচিন্তা সময়ের সীমা পেরিয়ে গেছে। ঋত্বিক কুমার ঘটক সেই বিরল নামগুলোর শীর্ষে।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর, ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই মানুষটি যেন জন্মগতভাবেই বিদ্রোহী ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘ভবা’ বলে ডাকত, কিন্তু তাঁর ভেতরের মানুষটার নাম ছিল—অস্থিরতা। ময়মনসিংহের স্কুলজীবন থেকে রাজশাহীর পদ্মার তীরে কিশোর ঋত্বিক বেড়ে উঠেছিলেন নদীর সুর আর মানুষের কান্না মিশিয়ে।
দেশভাগ যখন হলো, তাঁর ভেতরটা যেন ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি একবার বলেছিলেন, “পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে নিজের দেশে আসা মানে, নিজের মা’য়ের কোলে যাওয়ার আগে অনুমতি চাওয়া।” এই কথাটাতেই বোঝা যায়, দেশ তাঁর কাছে ছিল আবেগ নয়—একটা জীবন্ত সম্পর্ক। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই মাটিতে পা রাখেননি।
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি—স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভাষা দিবসের দিন তিনি ফিরে এলেন। কিন্তু ফিরে পেলেন এক ভস্মীভূত বাস্তবতা। তাঁর বোন প্রতীতি দেবীর চোখে তখনও যুদ্ধের আগুন, কান্না, হারানো প্রিয়জনদের ছায়া। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রবধূ প্রতীতি হারিয়েছিলেন সংসার, শ্বশুর, শান্তি। সেই দগ্ধ ঘরের ভেতরেই একদিন তিনি ঋত্বিকের হাতে তুলে দেন অর্ধপোড়া এক পাণ্ডুলিপি—অদ্বৈত মল্ল বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম।
আর সেই রাতেই, বোনের সাদা শাড়ি দিয়ে তৈরি খাতায়, ঋত্বিক লিখে ফেললেন ইতিহাস—এক নদী, এক জাতি, আর এক মানুষের চলচ্চিত্র প্রতিশোধের কাব্য।
নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “ঋত্বিক দশ বছর এগিয়ে ছিলেন ভারতীয় সিনেমা থেকে।” আসলে ঋত্বিক ছিলেন এমন এক নির্মাতা, যিনি সময়ের হাত ধরেননি—সময়ই তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আজ তাঁর জন্মের শতবর্ষ। তবু তাঁর সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি চিৎকার, প্রতিটি নীরবতা আজও প্রাসঙ্গিক। কারণ ঋত্বিক ঘটক কেবল সিনেমা বানাননি—তিনি ইতিহাসকে পর্দায় অনুবাদ করেছিলেন, যেন আমরা বারবার নিজেদের দিকে তাকিয়ে শিখতে পারি, কে আমরা, কোথা থেকে এসেছি।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহী শহরে। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। নিজের পিতৃভূমি ছেড়ে শরণার্থী হবার মনের জ্বালা তার অন্তরে বড় ক্ষতের তৈরি করে। এর প্রভাব পড়ে তার নির্মিত সিনেমায়।
দেশভাগ নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)’, ‘কোমল গান্ধার (১৯৬১)’ এবং ‘সুবর্ণরেখা (১৯৬২)’। এই তিনটিকে একত্রে ট্রিলজি বলা হয়। তিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন কবি ও গল্প লেখক। এরপর তিনি যুক্ত হোন মঞ্চ আর গণ নাট্য সংঘের সঙ্গে। সেখান থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকেন তিনি।
মাত্র ৫১ বছরের জীবদ্দশায় ঋত্বিক কুমার ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সবমিলিয়ে ১০টি। আরও অনেকগুলো কাহিনীচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি। এই হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে; তিনি এই ছবিতে একই সাথে অভিনয় এবং বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এর দু’বছর পর ১৯৫৩ সালে তাঁর একক পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। দু’টি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে জোর ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি নির্মাতা হয়ে এসে তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রুপ দেন, যা মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র ও কীর্তিমান অভিনেত্রী কবরী এই ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় শেষ ছবি ‘যুক্তিতক্ক আর গপ্পো’। তাঁর সিনেমাকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন সমালোচকরা। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। আর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ১৯৭৫ সালে ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।