কালচারাল ইয়ার্ড ডেস্ক:
বিমানবন্দরের কাচঘেরা নিস্তরঙ্গ সকালে, সেতারের কাঠের দেহটিতে যে ক্ষতের রেখা জেগে উঠবে—আনুশকা শঙ্কর তা কল্পনাও করেননি। বহু সফর, বহু মহাদেশ, অসংখ্য মঞ্চ পেরিয়ে তাঁর সঙ্গী সেই সেতার। রবিশঙ্করের উত্তরাধিকার যেন মুঠোয় ধরা—তার গাছগড়া দেহে জমে আছে সময়, সাধনার ঘ্রাণ, সুরের অমলিন অনুশাসন। সেই সেতারেরই আজ নীরব, মরণশীতল এক ফাটল।
দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরেই তিনি যখন ঘরের শান্তিতে বসে টিউন করছিলেন বাদ্যযন্ত্রটি, তখনও কিছু টের পাননি। কিন্তু সুর তুলে বাজাতে যাচ্ছিলেন—সেটাই ছিল বিচ্ছেদের মুহূর্ত। সেতারের গোলাকার তুম্বায় ধরা বড় ফাটল যেন চোখের সামনে একেবারে সরু হয়ে উঠে এল, যেন হঠাৎই বোঝা গেল বহু বছরের সঙ্গের কোনও চিরে যাওয়া চিহ্ন।
“এই বাদ্যযন্ত্র যে দেশের, সেই দেশেরই বিমানে এমন ক্ষতি হলে বেদনা আরও গভীর হয়”—ইনস্টাগ্রামে ভিডিওতে বলতে বলতে তাঁর গলায় ঝরে পড়েছিল হতাশা। ১৫–১৭ বছরের ভ্রমণে যা কখনো হয়নি, তা ঘটল এবার—তাও দেশের জাতীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে।
ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করে আনুশকা দেখিয়েছেন, তার সেতারের নিচের গোলাকার অংশে একটি বড় ফাটল ধরেছে।এনডিটিভি লিখেছে, আনুশকা বলেছেন তিনি এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ভারতে ফিরছিলেন। ভারতে আসার পর বাড়িতে সেতার বাজাতে গিয়ে দেখেন সেটি ভাঙা। তার ভাষায়, গত ১৫ থেকে ১৭ বছরে এই প্রথমবারের মত তার বাদ্যযন্ত্রের এমন ক্ষতি হল।
ভিডিওতে আনুশকা বলেন, “প্রথমে আমি শুধু সেতারের উপরের অংশটা দেখছিলাম, তেমন কিছু বুঝিনি। টিউন করার পর যখন সেটি তুলে বাজাতে গেলাম, তখনই বিষয়টি বুঝতে পারি যে সেতারের কী অবস্থা হয়েছে। অনেক বছর পর আমি এয়ার ইন্ডিয়ায় উঠেছিলাম। এই বাদ্যযন্ত্র যে দেশের, সেই দেশের বিমান সংস্থায় করেই এই ক্ষতি হল। গত ১৫ বা ১৭ বছরে এমন কিছুই হয়নি। কীভাবে আপনারা এমন করলেন? আমার সেতারের জন্য বিশেষ কেস রয়েছে। আপনারা হ্যান্ডলিং ফি নেন, তারপরও এমন হল!”
এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, তদন্ত চলছে। দিল্লি বিমানবন্দরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হচ্ছে, তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে—যেন এ শব্দের ভেতর দিয়ে কোনওভাবে ছুঁয়ে দিতে চায় আনুশকার ক্ষত-বিক্ষত মনকে। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রের ক্ষত কি কখনো শুধু ক্ষত থাকে? সে তো শিল্পীর শরীরেরও অংশ, সাধনারও প্রাচীন অঙ্গ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সহমর্মিতা জানালেন শিল্পীরা। বিশাল দাদলানি বললেন—হৃদয়বিদারক। পাপন লিখলেন—যত্ন পাওয়াটা আজ ভীষণ দুষ্কর হয়ে উঠেছে। যেন সেতারের ফাটলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের সময়ের ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া মমত্ববোধ।
রবিশঙ্করের তৃতীয় স্ত্রী সুকন্যা শঙ্করের সংসারে জন্ম নেওয়া আনুশকা, ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন বাবার আঙুলের নাচন, রাগের দোলা, রেওয়াজের নিশ্বাস। আজ যখন তিনি নিজেই বিশ্বমঞ্চের তারকা, বহু গ্র্যামি মনোনয়ন পাওয়ার পরও তাঁর সেতারের প্রতি অনুরাগ সেই প্রথম দিনের মতোই সতেজ। তাই ভাঙা সেতার যেন তাঁর ব্যক্তিগত ইতিহাসে এক অপ্রত্যাশিত দাগ।
আগামী জানুয়ারি থেকে শুরু হবে তাঁর ভারত সফর—দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু—ছয় শহরে ছয় সন্ধ্যা। সুরের পূর্ণতা দিয়ে, শ্রোতার হৃদয়ে আবার নতুন রস ঢেলে দিতে প্রস্তুত তিনি। তবে সুরের শিখা জ্বালানোর আগে ভাঙা সেতারের ব্যথা তাঁকে যেন আরেকবার মনে করিয়ে দিল—শিল্প শুধু মঞ্চে নয়, জীবনেও ভেঙে যায়, আবারও জোড়া লাগে।