ফারুক আহমাদ আরিফ:
মানুষকে মানুষ কীভাবে চিনবে? তাকে চেনা-জানার মাধ্যম কি হতে পারে? নানাজন নানা ধরনের কথা বলে থাকেন। কেউ হয়তো বললো লোকটির কত ধন-সম্পদ আছে তা দিয়ে বিচার করুন। আবার অপরজন বললেন না, তার শিক্ষা-দীক্ষা কেমন সেটি দিয়ে বিচার করুন। কারো কারো অভিমত সেই লোকটি কোন বংশে জন্ম নিয়েছেন তা দিয়ে বিচার করুন। একেক মানুষের একেক মত। একেক চিন্তা। কিন্তু চিন্তাগুলোর সমন্বয় কীভাবে করবেন?
মানব সৃষ্টির প্রথম পর্ব থেকেই তাকে তার সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা প্রথমেই তাকে তার কাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি নিজে শিখিয়ে ফেরেস্তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে বিজয়ী করেছেন। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত মানুষের প্রথম শিক্ষাই তার সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি শব্দটির ইংরেজি হচ্ছে Cultural। এটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কৃষ্টি, চিৎপ্রকর্ষ, অনুশীলনের অর্জিত জ্ঞান-বুদ্ধি। শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে। তখন সংস্কৃতি বলতে বোঝানো হতো কোনস্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবন-জীবিকা নির্বাহের উপায়, শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদিকে। অর্থাৎ মানুষের সার্বিক জীবনাচারকেই সংস্কৃতির আওতায় নিয়ে আসা হয়।
প্রশ্নটি হচ্ছে সংস্কৃতি কীভাবে সমাজের শিক্ষক? বিষয়টি নিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেই বেরিয়ে আসবে সেটি। আমার কথা মাপার জন্যে কোন দাঁড়িপাল্লা নিয়ে রাস্তায় আপনি নামবেন না। আমাকে বিচার করতে হলে মাপতে হলে আমার কথা দিয়ে, প্রকাশের ভঙ্গি দিয়ে, কাজ দিয়ে।
পোশাক দেখে যে মানুষ চেনা যায় না সেটি ইরানি কবি শেখ সাদীর রাজবাড়িতে সাধারণ পোশাক পড়ে রাত্রিযাপনে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় রাজকীয় পোশাক নিয়ে হাজির হওয়ার গল্পটি নি:সন্দেহে আমরা ভুলিনি।
সঙ্গীতের ভুবনে যদি ডুব দেন তবে সেখানকার সুর লহরি আপনাকে আলোড়িত করবে কিন্তু সেই সঙ্গীতটি যদি হয় সমাজবিরোধী সেখানে কি পাবেন?
ভালো কি মন্দ বিচারের জন্যে আপনার আমার বিবেকই সবচেয়ে বড় আদালত। একটি কাজ করতে গিয়ে বিবেককে প্রশ্ন করেন এটি আমার দ্বারা করা প্রয়োজন কিনা? তখন সেখান থেকেই নির্দেশ পাবেন কি করতে হবে? এখানে একটি প্রশ্নও দাঁড়ায় যে যখন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে হত্যা করে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করতে তখন কি বিবেক সাড়া দিবে? এটির দুটি উত্তর।
কালচারাল ইয়ার্ডের আরও কিছু প্রবন্ধ
⇒ বাঙালি সংস্কৃতিতে ঈদ
আপনি নিজেকে অপরাধী হিসেবে গড়ে তুললে সেটির জবাব পাবেন এক ধরনের। আবার নিজেকে মহৎ করে গড়ে তুললে পাবেন ভিন্ন জবাব। কিন্তু ‘অপরাধ’ করতে গেলেও বিবেক আপনাকে থামিয়ে দিবে এটিই হচ্ছে বিবেকের সংস্কৃতি।
প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতিগুলোর বেশিরভাগই ছিল নারী দেহের গোপনীয় বিষয়গুলে নিয়ে। কিন্তু এই নারীকে যখন আপনি নিজের মা, বোন, স্ত্রী বা সন্তান হিসেবে বিবেচনা করেন তখন কি এমন কিছু লেখতে তা ছবি আঁকতে পারবেন যা তাদের সাথে বলতে পারবেন? আবার সকলের সামনে বলার বা ব্যবহার উপযোগী হলেই সেটি সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু যদি অপরাধবোধে লোকাতে চান সেটি আর সংস্কৃতি হলো না।
বাঙালির সংস্কৃতি কি? এটি নিয়ে কত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে। আমরা কি আমাদের শেকড় হারাচ্ছি এই যুগে এসে? বাঙালির সংস্কৃতিই হচ্ছে অপরের সাথে সৎভাব নিয়ে সাহসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা। কোন কিছু যদি সৃষ্টিজগতের জন্যে অকল্যাণকর হয় সেটি পরিহার করা। কিন্তু এখন সংস্কৃতির কোন ভূমি দিয়ে আমরা হেটে যাচ্ছি? নিজেদের চেতনাবোধ হারিয়ে ফেলছি!
মানুষের জন্মের প্রধান কারণই হচ্ছে সৃষ্টিকুলের কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু সেই কল্যাণ আমরা কতটুকু করছি। নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে তার কলতান আমরা বন্ধ করে দেই। পাখির কূজন বন্ধ করতে বন করছি উজাড় এখন মানুষের সংস্কৃতি বলতে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস।
একমাত্র মানুষ ছাড়া সকল প্রাণী তার বিপদ থেকে উদ্ধারকর্তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে কিন্তু মানুষ সেটি ভুলে গিয়ে তাকে বিপদে ফেলে। একটি সাপকে যদি কখনো বাঁচান সে কখনো আপনাকে ছোবল দিবে না। বাঘকে যদি বাঁচান সে আপনাকে দিয়ে ভুরিভোজ করবে না কিন্তু আমরা মানুষরা!
তবে আশার আলো হচ্ছে সমাজে সংস্কৃতিবানরা সমাজকে গড়ে তোলে বিনিময়ের আশা না করে। চারপাশের শক্তি-সম্পদকে ব্যবহার করে সকলের প্রাণে আনন্দের জোয়ার তুলে।
সব বিবেচনা করে সংস্কৃতিই সমাজের শিক্ষক এটি মানতে বাধা দেখি না।
লেখক: সাংবাদিক