সন্দীপ :
ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি অথবা সিনেমাটোগ্রাফার কিংবা ক্যামেরাম্যান, শব্দগুলো হয়ত এখন আর খুব অপরিচিত নয় পাঠকের কাছে। এরা করেন কি, না সিনেমা তোলেন, ছবি তোলেন, এটাও বোধহয় অজানা নয়। ছবি তো এখন সবাই তোলে। সবার পকেটেই মোবাইল ফোন, ছবি তুললেই হয়। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কের কল্যাণে সে ছবি ঘরে ঘরে পৌঁছেও যায়। তাহলে এই সব পদগুলো কেন আছে আর কেনই বা তাদের বিশেষ গুরুত্ব? কেউ কেউ তো দিব্বি ‘ভেডিও ক্যামেরা’ বাগিয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ির ছবি তুলছে আর এর মধ্যে গান ফান জুড়ে তেড়ে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে সিনেমা করনেওয়ালাদের তফাত কোথায়?
সবাই বলবেন তফাত তো টাকার। মানা গেলো কথাটা একেবারে তুরুচ্ছু করার মত নয়। কিন্তু শুধুই কি টাকা? তাহলে যার টাকা আছে সে-ই সিনেমাটোগ্রাফার হচ্ছে না কেন? প্রডিউসার হচ্ছে, এমন কি অভিনেতা হওয়ার জন্য চেষ্টাও কম করছে না। তবে ক্যামেরাপারসন হতে বাঁধা কোথায়? অথচ যারা ভালো সিনেমা বানাতে চান, তারা কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ভালো সিনেমাটোগ্রাফারকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য অপেক্ষা করেন। তাহলে ভালো সিনেমাটোগ্রাফি কি?
![](http://i1.wp.com/culturalyard.com/wp-content/uploads/2018/03/Sandip.jpg)
ক্যামেরার পিছনে কর্মরত লেখক
এই যে লেখাটা পড়বেন বলে শুরু করেছেন, যাঁকে নিয়ে লেখাটা তিনি কে? একজন সিনেমাটোগ্রাফার। তিনি কী ভালো সিনেমাটোগ্রাফার? কেন তাঁর কাজ ভালো? শুধুই কী পৃথিবীখ্যাত পরিচালক তাঁকে কাজে ডাকতেন বলে ভালো? তাহলে যখন তিনি নতুন বা অনামী পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলেন, তখন কী তিনি খারাপ কাজ করেছেন?
আসলে সিনেমাটোগ্রাফিকে বিচার করতে গেলে যে পরিমাণ জ্ঞান লাগে তা সাধারণ মানুষের কাছে আশা করা অনুচিত। আর সিনেমার সঙ্গে যুক্ত মানুষরাই যে কতটা বুঝতে পারেন তা তর্কের বিষয়। যদিও ব্যক্তি মানুষটির আকর্ষণ কিছু কম নয় বা এমন নয় যে, তাঁকে ঘিরে করার মত গল্প কিছু কম আছে। তবুও কেন জানি না একটা খচখচানি মনের মধ্যে পাক খেয়ে ওঠে বারবার; মূল্যায়ন বলে যে শব্দটা প্রচলিত, তার সঙ্গে জড়িত দায়িত্ব কে নেবে ?
সিনেমাটোগ্রাফি বুঝি বলে মনে করি, তার সুবাদে শিক্ষাদানের পবিত্র কর্তব্য কেন ঘাড় পেতে নেব? কিন্তু না হলে ‘সৌমেন্দু রায়’ নামটি যাদের কাছে নাম হিসাবে রয়ে গেছে। বড়জোর খুব ভালো সিনেমাটোগ্রাফার এই পর্যন্ত যারা পৌঁছেছেন, তাদের সদিচ্ছার প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করা হবে না। যদি একজন পাঠকও এরপর কোন সিনেমা দেখে সিনেমাটোগ্রাফি সম্বন্ধে আপামর গণমাধ্যমের থেকে দু’টো বাক্য বেশি ব্যয় করতে সক্ষম হন তাহলে কিছুটা পরিশ্রম সার্থক হলো বলে মনে করবো।
ভালো সিনেমাটোগ্রাফির প্রথম আর প্রধান শর্ত হলো বিষয়ানুগ হওয়া, তার মানে যদি গল্প বলা হয় তবে সেই গল্পের সঙ্গে সমান তালে চলা। ধরুন একটা ভুতের গল্প বলা হচ্ছে আর ক্যামেরাটা বলছে হাসির গল্প তাহলে তো মুশকিল। সিনেমা যদি ভুতের হয় ক্যামেরাকেও ঠিক গল্পের টানাপোড়েন অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ ক্যামেরা এমনভাবে বসবে, তার নড়াচড়া এমন হবে যেন ভৌতিক পরিবেশটাকে বের করে আনতে পারে।
সঙ্গে থাকবে আলোর ব্যবহার। আলো ছায়া মিশিয়ে ভৌতিক আবহটা ঘনঘোর হয়ে উঠবে। আবার যখন প্রেমের দৃশ্য আসবে তখন ক্যামেরা সেই রোমান্টিক মুডটিকে সাজিয়ে তুলবে। কোথাও রঙের প্রয়োগে কখনো ফিল্টার, মানে ক্যামেরার সামনে একটুকরো বিশেষ রকমের কাঁচ রেখে দৃশ্যকে আরও নয়নাভিরাম করে তোলে। এছাড়াও আরও নানারকম টেকনিকের প্রয়োগ চলতেই থাকে।
আসল কথা হলো গল্পের চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশ বানানো, হয়ত যতটা দেখা যাচ্ছে তার বাইরে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ, যেমন দিন আর রাত। সিনেমাতে কখন রাত দেখানো হচ্ছে আর কখন দিন দেখানো হচ্ছে তা গল্পের ওপর নির্ভর করে। যেমন ধরুন, গল্পে আছে যে সারারাত্রি ঝগড়া ও কান্নাকাটির পর ভোরবেলা নায়ক নায়িকা চোখ মুছে উঠে বসছে, এখন শুটিং এর সময় ধার্য হয়েছে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা তাহলে কখনই ভোরবেলা পাওয়া গেল না। এখন সিনেমাটোগ্রাফারকেই দায়িত্ব নিয়ে দিনের বেলায় ভোর তৈরি করতে হবে।
জানালা দিয়ে আসা ঝকমকে রোদ্দুরকে কালো জাল লাগিয়ে ছেঁকে ছেঁকে ভোরের নরম আলোয় পরিবর্তিত করতে হবে। মুশকিলটা হলো কখনই তাই ভালো সিনেমাটোগ্রাফারের কাজ দেখে বোঝা যাবে না যে, এটা ভোর ছিলো না। একজন পরিণত চিত্রকরের মতোই তিনি সুনিপুণ হাতে ঢেকে দেবেন তুলির টানের দাগগুলোকে।
অথচ কোনদিনই চারুশিল্পী বা ফাইন আর্টিস্ট হিসাবে কোনো সন্মান তাঁকে কেউই দেবে না। সিনেমার জনপ্রিয়তার ভিড়ে, নক্ষত্রমণ্ডলীর দাপটে আর অবিরত ঘটে চলা প্রচার মাধ্যমের ঢক্কানিনাদের মধ্যে চুপিসারে কাজ করে যেতে হবে তাঁকে। লোকেশন বা যেখানে শুটিং হবে জায়গাটা বাছার সময় ভাবতে হবে সূর্য কোথা থেকে কোথায় যাত্রা করবে? সারাদিন সেইভাবে শটগুলো নিতে হবে, যাতে সূর্যের আলো আসে মাথার পেছন থেকে অথচ ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে পরিস্কার নীলাভ আকাশ। না হলে দেখতে ঠিক লাগবে না।
নায়িকার মুখ না দেখে লোকে তখন জ্বলে যাওয়া আকাশ দেখতে থাকবে। এই সমস্ত পরিশ্রম কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য, যাতে লোকে অভিনয়টাই মন দিয়ে দেখতে পায়।
সিনেমাটোগ্রাফি নিজেকে জাহির করার শিল্প নয়, নিজেকে লুকিয়ে রাখার কৌশল। গল্পের স্বার্থে গল্পের জন্য, গল্পের মোহমায়ায় দর্শককে আচ্ছন্ন করে তোলার জন্য সিনেমাটোগ্রাফার কাজ করেন। বিজ্ঞ সাংবাদিক তাঁর কাজকে এক লাইনের উল্লেখে সেরে দেবেন ক্যামেরা যথানুগ। এই মনোভাব তৈরি হওয়ার কারণ একশ বছর পেরোনো সত্বেও আজও দেশজ ভাষার কোনো পত্রিকা বা সাময়িকী সিনেমার সঠিক পর্যালোচনা বের না করা।
সঠিক পর্যালোচনা কি সেটা যে কোনো সংখ্যার ‘Sight and Sound ‘ পত্রিকাটি দেখলেই বোঝা যাবে। এ উপমহাদেশের যে কোনো চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই পরিস্কার হয়ে যাবে আজও কলাকুশলীরা কতোটা অপাংক্তেয়। কোনো অনুষ্ঠানেই তাদের বক্তব্য রাখার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়না, যেন তাদের কিছু বলার বা কাউকে ধন্যবাদ দেওয়ার নেই, “ওরা আবার কি বলবে ?”
অথচ নাচগানের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করা হচ্ছে। অস্কারের মতো অনুষ্ঠানেও কিন্তু প্রত্যেককে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের সমান সুযোগ দেয়। কিন্তু এই উপমহাদেশে অভিনেতা আর পরিচালক বাদে আর কেউ মানুষ বলেই গণ্য হয়না। এই বিমাতৃসুলভ আচরণ সত্বেও শুধুমাত্র নিজের শিল্পমাধ্যমের প্রতি ভালবাসা থেকে যে মানুষটা তাঁর জীবন সমর্পণ করে দিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফির জন্য, শত সুযোগ থাকার পরও কোনদিন পরিচালনায় বা অন্য কিছুতে আসেননি তাঁর কাজগুলো ভালো করে বারবার দেখার চেষ্টা করুন। হয়ত একদিন বুঝে উঠতে পারবেন কেন তিনি ভালো সিনেমাটোগ্রাফার?
লেখক: সিনেমাটোগ্রাফার, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রাক্তণী, রামোজি ফিল্ম সিটির সিনেমাটোগ্রাফির অধ্যাপক।
It’s a very good analytical writing, that highlights the huge amount of hard work put in by a “cameraman” and/or any technician to create the magic on celluloid. However, that gets lost in darkness created by their magic.
prodiper tolar andhokare hariyei jaan Tanra….dhanyobad
Salute to all camerapersons in the world who are the primes of movie making.
because of them ,the cinema forms….kudos…..thanks Santanu
Jara bojhena tara baparta kodor korbe ki .. Kom budget koto movie release hoy kintu koto bhalo cinematography.. Akta chobite camera kaaj ar photography artwork ta akta guruto purna jaiga chobi take tule dhorar
ekdom thik…..jodi ei lekha pore ek joner o sochetanota baare,setai paoya….dhanyobad
Very well written. Creating day and night and reference to Sight and Sound are very apt.
Thanks,Sir…Its great to hear from you.
একদম বাস্তবোচিত লেখা।
অভিজ্ঞতা থেকে অনুভূত…
Cultural Yard এর সকল সাথীকে ধন্যবাদ, বিশেষ করে রোমান কবিরকে….
কালচারাল ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে আপনার ও আপনার সতীর্থদের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। আপনাদের পরামর্শ, লেখা ও সার্বিক সহযোগিতা আমাদের পাথেয় হবে।
Khub valo laglo pore… dhonyobad