বিশেষ প্রতিবেদক :
ঋতুপর্ণ ঘোষ সবাই জানেন ছবি বানায় বড়দের জন্য। সে ছবিতে সবাই গম্ভীর চিন্তা করে। চোখাচোখা কথায় ঝগড়া করে। কথায় কথায় কান্নাকাটি করে, চিৎকার করে বা নীরবে। কষ্ট পায় বা কষ্ট দেয়। কোথাও কোনো ঝলমলে হাসিমুখ নেই। ঝড়ঝড়ে প্রাণ জুড়ানো হুল্লোড় নেই। রোদ্দুর বলতে পর্দার বা চিকের ফাঁক দিয়ে আসা আলোর চিলতে। আদিগন্ত নীল আকাশ নেই, আবনান্ত বিথীপথ নেই। ঋতুপর্ণের দম আটকে আসছিলো। সিনেমা হলের দম বন্ধ অন্ধকার থেকে, কান্নাকাটি ঝগড়াঝাটি থেকে রুমাল বের করার খসখস বা নাক টানার আওয়াজ থেকে। ঋতুপর্ণ পালাচ্ছিল ঋতুপর্ণ থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের কবি, দার্শনিক ঋতুপর্ণ ঘোষের নিজের সম্পর্কে এই উপলব্ধিই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয় পুরোপুরিভাবে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা। ভিন্ন ধারার বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকনির্দেশক। সস্তা স্থুল বিনোদনের পথে হাঁটেননি তিনি। হেঁটেছেন কন্টাকীর্ণ পথে। এঁকেছেন চলচ্চিত্রকাব্য। সাহিত্য ও দর্শনের প্রতিরুপ যে সুন্দরভাবে আঁকা যায় চিত্রপটে তাঁর জ্বলজ্বলে উদাহরণ ঋতুপর্ণ। বাংলা চলচ্চিত্রকে দিয়েছেন তিনি অনন্যমাত্রা। সত্যজিত রায় দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি হেঁটেছেন নিজের বানানো পথে। তাঁর ভাষ্যে, তাঁর চিন্তায়, তাঁর ছবিতে ফুটে ওঠে তাঁর দার্শনিক রুপ। একটি পরিস্ফুট চেতনার উন্মেষ ঘটে তার সিনেমায়। ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রের ভক্তকুল মানেই তাঁর চেতনা দ্বারা প্রভাবিত।
তাঁর ভাষ্য, সে আজকে সতেরো বছর আগের কথা, তখন আমার বয়সও অনেক কম, মনটাও অনেক কাঁচা, আর হাজার হোক প্রথম ছবি বলে কথা, কত খেটে, কত যত্ন করে কত খসরা পাল্টে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম, কেউ যেন ভুল ধরতে না পারে।
তাঁর সম্পর্কে প্রায় প্রতিটি বাঙালি নির্মাতা, অভিনেতা অভিনেত্রী থেকে শুরু করে সবার উক্তি, ঋতুপর্ণ আছে বাঙালির হৃদয়ে। তিনি বাঙালির চিন্তাকে ধরতে পেরেছিলেন। বাঙালির অনুভূতির সর্বোত্তম ব্যবহার করেছিলেন। আর তাই সবার সচেতন হৃদয়ে, সবার চেতনে অবচেতনে ধরা দিয়ে যায় ঋতুপর্ণ ঘোষ। পুরুষকে বুঝতে পেরেছিলেন, নারীর সত্তাকে আরও গভীরতা দিয়েছিলেন।
রুচিহীন সস্তা বিনোদিত বাঙালির জন্য ঋতুপর্ণ ঘোষ সিনেমা বানাননি। তিনি ছবি বানিয়েছেন রুচিশীল মধ্যবিত্ত বাঙালির জন্য। আর তাই তার দর্শকমাত্রই ছিলো সামান্য। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ ছিলো না তাঁর। নিজের দর্শন ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি পরিপূর্ণভাবে। আর তার সঙ্গে একাত্ব যে সব মধ্যবিত্ত বাঙালি গালে হাত দিয়ে দেখেছেন তাঁর ছবি, আর ভেবেছেন। নিজেদের মননে চেতনে, অবচেতনে জায়গা দিয়েছেন ঋতুকে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ আজ আর নেই। ২০১৩ সালের ৩০ মে হৃদরোগে আক্রান্ত মারা যান। মাত্র ৪৯ বছর বয়স। যে বয়সে কেবল শুরু হওয়ার কথা, সেখানেই সফল সমাপ্তি। তবে আরও দিতে পারতেন। তুলে নিয়ে যেতেন বাঙালিকে বিশ্বদরবারে। গুণী এই চলচ্চিত্র দার্শনিকের প্রতি কালচারাল ইয়ার্ড শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী
ঋতু চলে গেছে ঋতুরাজ হয়ে
পড়ে আছে স্মৃতির পাহাড়
ঋতুরাজের ঋতুবসন্তে
ছত্রে ছত্রে বাহার।
ঋতু মানেই সৃষ্টি
ঋতু মানেই চেতনা
গন্ধে বর্ণে ছন্দে স্বপ্নে
নিজেই নিজের প্রেরণা।
চলে গেছে ঋতু, হয়ে গেছে ইতি
পরে আছে শুধু জুঁইফুল স্মৃতি।
যেখানেই থাকো, সেখানেই গড়ো
নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করো।
নতুন পথের তুমি স্বপ্ন মুর্ছনা
রৌদ্র্র হাওয়ায় তৃমি সুর জোছনা
তুমি শিল্পীর প্রেরণা
তুমিই তোমার তুলনা
আবার এসো গো ফিরে
বাংলার মাটির মাঝারে।
ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয় বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায়। ১৯৯২ সালে চলচ্চিত্রে এসে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম ছবি হিরের আংটি। ১৯৯৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় ছবি উনিশে এপ্রিল মুক্তি পায়। এই ছবিতে এক মা ও তাঁর মেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কাহিনী তুলে ধরেছেন তিনি। এটি দেশে বিদেশে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়। ১৯৯৫ সালে এই ছবি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
এরপর তিনি একে একে নির্মাণ করেন দহন, অসুখ, বাড়িওয়ালি, তিতলি, চোখের বালি, শুভ মহরত, অন্তরমহল, আবহমান, হিন্দি ছবি রেইনকোট, চিত্রাঙ্গদাসহ অসংখ্য সিনেমা। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।
তিনি বারোটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। পেয়েছিলেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বাংলা চলচ্চিত্র ঋণী হয়ে রইল এই গুণী নির্মাতার প্রতি।