বিশেষ প্রতিবেদক:
‘আজকে সতেরো বছর আগের কথা, তখন আমার বয়সও অনেক কম, মনটাও অনেক কাঁচা, আর হাজার হোক প্রথম ছবি বলে কথা, কত খেটে, কত যত্ন করে কত খসরা পাল্টে স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম, কেউ যেন ভুল ধরতে না পারে। ঋতুপর্ণ ঘোষ, সবাই জানেন ছবি বানায় বড়দের জন্য। সে ছবিতে সবাই গম্ভীর চিন্তা করে। চোখাচোখা কথায় ঝগড়া করে। কথায় কথায় কান্নাকাটি করে, চিৎকার করে বা নীরবে। কষ্ট পায় বা কষ্ট দেয়। কোথাও কোনো ঝলমলে হাসিমুখ নেই। ঝড়ঝড়ে প্রাণ জুড়ানো হুল্লোড় নেই। রোদ্দুর বলতে পর্দার বা চিকের ফাঁক দিয়ে আসা, আলোর চিলতে। আদিগন্ত নীল আকাশ নেই, আবনান্ত বিথীপথ নেই। ঋতুপর্ণের দম আটকে আসছিলো। সিনেমা হলের দম বন্ধ অন্ধকার থেকে, কান্নাকাটি ঝগড়াঝাটি থেকে রুমাল বের করার খসখস বা নাক টানার আওয়াজ থেকে। ঋতুপর্ণ পালাচ্ছিল, ঋতুপর্ণ থেকে।’ – ঋতুপর্ণ ঘোষ
বাংলা চলচ্চিত্রে এক ভিন্ন আমেজের জন্ম দেয়া ঋতুপর্ণ ঘোষ একই সাথে একজন সাংবাদিক ছিলেন, ছিলেন কবি। তাঁর জীবন থেকে সিনেমা প্রতিটি পরতে দার্শনিকতার ছোঁয়া। উৎসব, বাড়িওয়ালি, দহন, তিতলি, হীরের আংটিসহ অসংখ্য সিনেমা বানিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি ছবি একেকটি বোধের উন্মেষ ঘটিয়ে যায়, ভাবতে শেখায়। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট জন্মেছিলেন গুনী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা।
১৯৯২ সালে হিরের আংটি সিনেমা দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর একে একে নির্মাণ করেন উনিশে এপ্রিল, দহন, অসুখ, বাড়িওয়ালি, তিতলি, চোখের বালি, শুভ মহরত, অন্তরমহল, আবহমান, হিন্দি ছবি রেইনকোট, চিত্রাঙ্গদাসহ অসংখ্য সিনেমা। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পরবর্তী ছবি সত্যান্বেষী-র শ্যুটিং শেষ করেছিলেন। এই ছবিটি গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হচ্ছিল।
তিনি বারোটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। পেয়েছিলেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বাংলা চলচ্চিত্র ঋণী হয়ে রইল এই গুণী নির্মাতার প্রতি।
ঋতুপর্ণ ঘোষের আরও খবর
⇒ ঋতুপর্ণ ঘোষ: এক সাহসী যোদ্ধা
বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিত রায় পরবর্তী সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের অনুরাগী। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন ভারতের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। জীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি রূপান্তরকামী জীবনযাত্রা নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন। তিনি নিজের সমকামী সত্ত্বাটিকে খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেন, যা ভারতের চলচ্চিত্র জগতের খুব কম মানুষ করেছেন। তাঁর নিষ্ঠা ও সাহস অনেক দুর নিয়ে যেতে নিজেকে সাহায্য করে।
অর্থনীতির ছাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট হিসেবে। দুই দশকের কর্মজীবনে তিনি বারোটি জাতীয় পুরস্কারের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ঋতুপর্ণের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চিত্রাঙ্গদা। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদার কাঠামো অবলম্বনে নির্মিত। এটি ৬০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়।
ঋতুপর্ণ ঘোষ দশ বছর ধরে ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস টাইপ রোগে এবং পাঁচ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রা রোগ ছিল এবং সেই জন্য তিনি ঘুমের ওষুধ খেতেন। ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প ছবিতে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাঁকে এগুলি করাতে হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৩০ মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার নিজ বাসভবনে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি।