বিশেষ প্রতিবেদক:
‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’-বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের বিখ্যাত উক্তি। চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে ভাবতেন, শিল্পে যাপন করতেন। কেউ যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন তিনি কে: তিনি বলতেন: ‘আমি এক মাতাল। ভাঙা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল’। বাঙালীর জন্য সিনেমা নির্মাণ করতেন। কিন্তু তার ছবি স্থুল বিনোদন না। তার ভাষ্যে- ‘আমি প্রতি মুহুর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাবো যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি।’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি বোধের জায়গা করে দিতেন ঋত্বিক। বাঙালির ব্যাথা, বেদনা, যন্ত্রনা ফুটে উঠতো। যে যন্ত্রনা তার নিজেরও। বাংলা ভাগ হয়ে গেলো। যেন এক মায়ের এক জঠর ভাগ হয়ে গেলো। এসবই বলতেন তিনি তাঁর সিনেমায়। সিনেমা তাঁর কাছে প্রতিবাদের ভাষা।
ঋত্বিক কুমার ঘটক। এক প্রতিবাদী চলচ্চিত্রকার। ছিলেন নাট্যকার, লেখক ও অভিনেতা। তাঁর লেখায়, তাঁর নির্দেশনায়, তাঁর অভিনয়ে প্রতিবাদই ছিলো প্রধান। এক হাতে জ্বলন্ত পাতার বিড়ি আরেক হাতে বাংলা মদের বোতল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন জীর্ণ শীর্ণ রোগা পাতলা এই মানুষটি। পরণে থাকতো পুরনো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। এলোমেলো চুলের সঙ্গে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ঝুলতো ঝোলা। যেই ঝোলায় তিনি ফেরি করতেন শিল্পমাখা হাজারও স্বপ্ন।
জন্মদিনে কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা সিনেমার কবি ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল ঋত্বিক কুমার ঘটক।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহী শহরে। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। নিজের পিতৃভূমি ছেড়ে শরণার্থী হবার মনের জ্বালা তার অন্তরে বড় ক্ষতের তৈরি করে। এর প্রভাব পড়ে তার নির্মিত সিনেমায়।
ঋত্বিক কুমার ঘটকের আরও খবর
⇒ সিনেমার ক্ষ্যপাটে ঋত্বিক ঘটকের প্রয়ান দিবস
⇒ প্রয়ানের ৪২ বছর পরও অমলিন ঋত্বিক ঘটক
দেশভাগ নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)’, ‘কোমল গান্ধার (১৯৬১)’ এবং ‘সুবর্ণরেখা (১৯৬২)’। এই তিনটিকে একত্রে ট্রিলজি বলা হয়। তিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন কবি ও গল্প লেখক। এরপর তিনি যুক্ত হোন মঞ্চ আর গণ নাট্য সংঘের সঙ্গে। সেখান থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকেন তিনি।
মাত্র ৫১ বছরের জীবদ্দশায় ঋত্বিক কুমার ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সবমিলিয়ে ১০টি। আরও অনেকগুলো কাহিনীচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি। এই হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে; তিনি এই ছবিতে একই সাথে অভিনয় এবং বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এর দু’বছর পর ১৯৫৩ সালে তাঁর একক পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। দু’টি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে জোর ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি নির্মাতা হয়ে এসে তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রুপ দেন, যা মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র ও কীর্তিমান অভিনেত্রী কবরী এই ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় শেষ ছবি ‘যুক্তিতক্ক আর গপ্পো’। তাঁর সিনেমাকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন সমালোচকরা। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। আর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ১৯৭৫ সালে ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক সম্পর্কিত আর লেখা
→ চেতনা ধারায় এসে ঋত্বিককে স্মরণ
তিনি একে একে নির্মাণ করেন অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭), মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতী (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়া রং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫), হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)। এছাড়া বেশকিছু তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনের চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপাল হন।
আপনি কেন সিনেমা বানান? এমন উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি একেবারেই পাগল। সিনেমা না বানিয়ে থাকতে পারি না। আমাদের তো কিছু একটা করে বাঁচতে হয়, তাই না? তাই আমাকে সিনেমা করে বাঁচতে হয়। আসলেই তিনি ছিলেন পাগল। সিনেমার পাগল। শুধু বিনোদন না, তিনি সিনেমা বানাতেন মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে, তাদের অধিকার কি? গণমানুষের অধিকার আদায়ে, শোষণের বিরুদ্ধে শোষকের যন্ত্রণা ও তাদের ফুঁসে ওঠার চিত্র ফুটে উঠত তার সিনেমায়। তিনি বলতেন, সিনেমা আমার কাছে শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার।
মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিন বছর হাসপাতালে থাকার পর ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে মারা যান প্রতিবাদী সিনেমা নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক।