বিশেষ প্রতিবেদক :
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা দিবস। এটি ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ দিবসকে নিয়ে রচিত হয়েছে কত সাহিত্য, গান আর নাটক। তবে ৬ দশক পার হয়ে গেলেও মাত্র ৩টি ভাষা আন্দোলনের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ষাটের দশকে নির্মিত ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম সিনেমা নির্মাণ করেন প্রয়াত কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। তাঁর সেই সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র একটি বোধের জন্ম দেয়।
এরপর বহু বছর কেটে গেলেও নির্মিত হয়নি ভাষা নিয়ে কোন ছবি। ২০০৬ সালে নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন নির্মাণ করেছেন ‘বাঙলা’ নামে ভাষার চলচ্চিত্র। আর ২০১৯ সালে ভাষার দিনে মুক্তি পায় তৌকির আহমেদ পরিচালিত সিনেমা ‘ফাগুন হাওয়ায়’। অতি কম হলেও এ তিনটি সিনেমাই আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনা দর্শকহৃদয়ে জাগরুক রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম চলচ্চিত্র
উনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে চলা অস্থিরতার মধ্যে এফডিসির ২নং ফ্লোরে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার শুটিং করছিলেন জহির রায়হান। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে জহির রায়হান ছবি করছেন এমন খবরে আর্মি এসে হাজির শুটিং স্পটে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরিচালক জহির রায়হান ও অভিনেতা রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসেন তারা। তবে এরপর বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে সামরিক সরকারের কাছে জবাবদিহী করতে হয়েছে। হাজিরা দিতে হয়েছে। এর মধ্যেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন সিনেমার কাজ। অবশেষে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের উপর নির্মিত হলো প্রথম চলচ্চিত্র। এ ছবিটি শুধু একটি আন্দোলনের প্রতিচ্ছতিই নয়। এটি ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা। ছিলো একটি যুদ্ধ।
ছবিটির চিত্রনাট্য করেছেন প্রখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন। চিত্রগ্রহণে ছিলেন আফজাল চৌধুরী, সম্পাদনায় ছিলেন মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন খান আতাউর রহমান। আনিস ফিল্মের পরিবেশনায় অভিনয় করেন রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেন, শওকত আকবর, রোজি সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, বেবি জামান আমজাদ প্রমুখ। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি একটি পরিবারের গল্প বলে। যে পরিবার একটি দেশের রুপক। সিনেমার পোস্টারেই দেখা যায় এর স্লোগান-‘জীবন থেকে নেয়া, একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন।’
আরও পড়ুন : জীবন থেকে নেয়া: একটি আন্দোলন, একটি যুদ্ধ
ছবিটিতে জেলে আনোয়ার হোসেন ও রাজ্জাকসহ মুক্তিকামী রাজনীতিকরা নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালিদের উৎসাহ দিয়েছে। রাজ্জাকের নবজাতক এর নাম মুক্তি নামের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খা। ছবিটিতে ব্যবহার হয় রবীন্দ্রনাথের ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ কবিতাটি। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম ব্যবহার করেন জহির রায়হান তাঁর ছবিতে। সেখান থেকেই গানটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দেশ স্বাধীনের পর এটিই হয় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। অর্থাৎ ছবিটি প্রতিটি ফ্রেমে স্বাধীনতার আকাঙ্খার সার্থক চিত্রায়ণ করেছেন জহির রায়হান।
ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট আরও খবর
⇒ প্রভাত ফেরির মিছিল……
⇒ অমর একুশের গান
একটি পরিবারের সাংস্কৃতিক জাগরণ ও একটি বোবা মেয়ের কথা বলার চেষ্টা একে ঘিরে আবির্তত হয়েছে শহিদুল ইসলাম খোকনের সিনেমা ‘বাঙলা’। বোবা মেয়েটি পরিবারের অন্য সদস্যদের মত কথা বলতে চায়। গান গাইতে চায়। কিন্তু কথা বলতে পারেনা মেয়েটি। এরপরও তার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। একসময় একটি ভাষার মিছিল যায়। ছবিটি শেষ হয় ভাষার মিছিলের সঙ্গে একাত্ন হয়ে বোবা মেয়েটির কথা বলার চেষ্টার মধ্য দিয়ে। যেখানে সে কথা বলতে পারে। আর প্রথম যে শব্দটি সে উচ্চারণ করে সেটি হচ্ছে বাঙলা।
ছবিটিতে বোবা মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন শাবনুর। এতে আরও অভিনয় করেন মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ূন ফরিদীসহ অনেকে।
ভাষা আন্দোলনের সর্বশেষ চলচ্চিত্র
২০১৯ সালে ভাষা আন্দোলনের দিনে মুক্তি পেয়েছে তৌকির আহমেদের নির্মিত সিনেমা ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় টিটো রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্পের অনুপ্রেরণায় সিনেমাটি নির্মিত হয়। একটি মফস্বল অঞ্চলে পাকিস্তানী এক পুলিশ অফিসার সেই গ্রামের একে বউ কথা কও পাখিতে উর্দু শিখাতে চেষ্টা করে। সেখানে গ্রামের অন্যদেরও উর্দু শেখানোর ব্যবস্থা করে সে। সেখানে গ্রামের লোকজনও সেই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে একসময় একতাবদ্ধ হয়।
ছবিটিতে কেন্দ্রীয় দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম ও তিশা। চলচ্চিত্রটির পাকিস্তানী পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউডের শক্তিমান অভিনেতা যশপাল শর্মা। ছবিটিতে আরও অভিনয় করেছেন আবুল হায়াৎ, আফরোজা বানু, ফারুক হোসেন, ফজলুর রহমান বাবু, সাজু খাদেম, রওনক হোসেন আজাদ সেতু, আবদুর রহিম, হাসান আহমেদ প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র
এছাড়া ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত হয়েছে বেশকিছু প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। শবনম ফেরদৌসী নির্মাণ করেছেন ‘ভাষা জয়িতা’। রোকেয়া প্রাচী নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বায়ান্ন’র মিছিল। রফিক উদ্দিন আহমেদ ভাষা আন্দোলনের উপর নির্মাণ করেছেন ‘হৃদয়ে একুশ’। ছবিটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে।