বিশেষ প্রতিবেদক:
বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম নিশ্চিন্তপূর। এ গ্রামের এক শিশু দুর্গা তাঁর ধনী প্রতিবেশীর বাগান থেকে ফল চুরি করে এনে তাঁর বৃদ্ধা পিসী ইন্দির ঠাকুরনকে দেয়। সে তার ছোট হাড়িতে তা রেখে দেয়। ইন্দির ঠাকুরন একটি ফল দুর্গাকে খেতে দেয়। এটি হচ্ছে সত্যজিত রায় নির্মিত বিখ্যাত সিনেমা পথের পাঁচালীর প্রথম দৃশ্য।
এই দৃশ্যে প্রথমেই আমরা দেখতে পাই গ্রামের এক ধনীর বাগানে একটি জীর্ণ শীর্ণ দেহের শিশু দুর্গা ফল চুরি করে দৌড়ে পালায়। গ্রামের বাগানের মধ্যে ধনীর বাড়ির ছাদে গৃহবধূর পুজার দৃশ্য, বাগানের মধ্য দিয়ে দুর্গার দৌড়ে পালানোর দৃশ্য।
এরপর জঙ্গলের মধ্যে একটি ভাঙা জীর্ণ বাড়ি। সেখানে একটি ভাঙা বেড়ার দাওয়ায় বসে বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকুরন। দুর্গার হাতের ফল দেখে চোখ চকচক করে তার। একটি মাটির সানকিতে আরও ফলের সঙ্গে চুরি করা ফল রেখে দেয়। দুর্গার মা সর্বজয়ার মুখে সবসময় বিস্বাদের ছায়া। অভাবে যেন তার মুখ থেকে সকল মধু কেড়ে নিয়েছ। আর তাই দুর্গার চুরি করার জন্য দোষ দেয় ইন্দির ঠাকুরনকে। তার প্রতি খিটখিটে মেজাজ দেখায় সর্বজয়া। ইন্দির ঠাকুরণ তার সম্বল ছেঁড়া কাঁথা মাদুর আর একমাত্র পিতলের ঘটিটা হাতে নিয়ে রাগে গরগর করতে করতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আশ্রয় নেয় এক আত্নীয়ের বাড়িতে।
এভাবেই শুরু হয় পথের পাঁচালীর আখ্যান। এখানে আমরা দেখতে পাই প্রকৃত গ্রাম বাংলাকে। আমাদের কারও না কারও সাথে মিলে যায় এ আখ্যান। এই আখ্যান সর্বকালীন বাঙালি গ্রামীণ সমাজের প্রতিচ্ছবি যেন।
হরিহর ও সর্বজয়ার অভাবের সংসারের মধ্যে জন্ম নেয় একটি ছেলেশিশু অপু। অভাবের মধ্যেও সুখ যেন ছুঁয়ে যায় ভাঙা ঘরে। ইন্দির ঠাকুরন আবারও ফিরে এসে ভাইয়ের ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। পরের দৃশ্যে দাওয়ার এক প্রান্তে ইন্দির ঠাকরুন পা ছড়িয়ে বসে পাঁচ-ছমাসের বাচ্চা অপুকে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে দোলনা দোল খাওয়াচ্ছে অপর প্রান্তে খেলনা বাক্স নিয়ে দুর্গা আপন মনে খেলছে।
অপু ও দুর্গার মধ্যে খুব ভাব। তারা কখনও চুপচাপ গাছতলায় বসে থাকে। কখনও মিঠাইওয়ালার পিছু পিছু ছোটে, কখনও ভ্রাম্যমাণ বায়োস্কোপ-ওয়ালার বায়োস্কোপ দেখে বা যাত্রাপালা দেখে। সন্ধ্যাবেলা দু’জনে দূরাগত ট্রেনের বাঁশি শুনতে পেয়ে আনন্দ পায়। এর মধ্যে ইন্দির ঠাকুরন মারা যান।
হরিহর রায় পৈতৃক ভিটেয় তাঁর পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। পেশায় পুরোহিত। আয় সামান্য। লেখাপড়া জানেন। তাই কিছু ভাল যাত্রাপালা লিখে অধিক উপার্জনের স্বপ্ন দেখেন। বাস্তবে তিনি অত্যন্ত ভালমানুষ এবং লাজুক প্রকৃতির লোক। সকলে সহজেই তাকে ঠকিয়ে নেয়। পরিবারের তীব্র অর্থসংকটের সময়েও তিনি তাঁর প্রাপ্য বেতন আদায় করার জন্য নিয়োগকর্তাকে তাগাদা দিতে পারেন না। গ্রামে ভাল উপার্জন করতে সক্ষম না হয়ে হরিহর একটা ভাল কাজের আশায় শহরে যান। সর্বজয়াকে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, ভাল উপার্জন হলে ফিরে এসে ভাঙা বসতবাড়িটা সারিয়ে তুলবেন। হরিহরের অনুপস্থিতিতে তাঁদের অর্থসংকট তীব্রতর হয়। সর্বজয়া অত্যন্ত একা বোধ করতে থাকেন ও খিটখিটে হয়ে যেতে থাকেন।
বর্ষাকালে একদিন দুর্গা অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধায়। ওষুধের অভাবে তার জ্বর বেড়েই চলে ও শেষে এক ঝড়ের রাতে দুর্গা মারা যায়। এরপর একদিন হরিহর ফিরে আসেন। শহর থেকে যা কিছু এনেছেন তা সর্বজয়াকে বের করে দেখাতে থাকেন। সর্বজয়া প্রথমে চুপ করে থাকেন, পরে স্বামীর পায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। হরিহর বুঝতে পারেন যে, তিনি তার একমাত্র কন্যাকে হারিয়েছেন। অপু তার বোন দুর্গাকে হারিয়ে একা ও নি:স্ব হয়ে পড়েন। তারা গ্রাম ও পৈতৃক ভিটে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অপু বাবা মায়ের সঙ্গে গোরুর গাড়িতে চড়ে নতুন এক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
সত্যজিৎ লিখেছেন, অপুর পাঠশালায় যাওয়ার দিন থেকে শুরু করে দুর্গার মৃত্যু অবধি এক বছর সময় কল্পনা করে চিত্রনাট্যের ঘটনাগুলিকে ঋতু অনুসারে ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। এই দৃশ্যটিতে পৌঁছনোর আগের দৃশ্যগুলির মাধ্যমে সত্যজিৎ যেন পরবর্তী ঘটনার জন্য উপযুক্ত একটি পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করে নেন। ছবিতে আসল কাহিনি শুরু হয় এর পর থেকে, তাই এ পর্যন্ত কাহিনির সময় পার হয়ে যায় দ্রুত।
ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর বীভৎসতা অপু-দুর্গাকে হতবাক করে। জবুথবু ভাবে বসে থাকার অপ্রাকৃতিক ভাব তাদের ভয় দেখায়। অপুর চোখে তখনও বিস্ময়ের ছোঁয়া। দিদির ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া দেখেই সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। বালক-বালিকা দুটির কাছে মৃত্যুকে চাক্ষুষ করার প্রথম অভিজ্ঞতা আসে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের ছন্দপতনের মতো। মৃত মানুষটির শরীর যখন জড়বস্তুর মতো শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার শেষ সম্বল ঘটিটি ধাতব শব্দ করতে করতে গড়িয়ে যায় পুকুরের জলে। অপু-দুর্গা দৌড়ে ছুটে আসে জীবনের কাছে মৃত্যু দর্শনের ভয়াবহতাকে নিয়ে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, বাঁশগাছের ঘষটানির মর্মর শব্দ, নেপথ্য বাজনার মৃদু একঘেয়ে আওয়াজ দৃশ্যটিকে আরও মর্মান্তিক করে তোলে।
দুর্গা এ-ছবিতে দাপিয়ে বেড়ায়। তার উপস্থিতি ছবিতে একটা গতি এনে দেয়। তার প্রাণোচ্ছল প্রকৃতি কোনও আবরণ, কোনও সামাজিক বাছ-বিচার, ভালমন্দ মানে না। সে চুরি করে, হ্যাংলামি করে। প্রাণের উচ্ছলতায় সে সব কিছু উপভোগ করতে চায়। ভালো-অবস্থা খারাপ-অবস্থার ভেদাভেদ সে জানে না। মনেও আসে না। সেটা বড়রা করে। তাই সে স্বীকার করে না তাদের দীন-অবস্থাকে। পেড়া খাবার ইচ্ছায় সে ছুটে যায় ভাইকে নিয়ে চিনিবাস কাকার পেছন পেছন। মুখুজ্যে গিন্নি, সেজবউয়ের মুখঝামটা সহ্য করেও সে-বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলে অনায়াসে, হয়তো খাওয়ার লোভে। পুঁতির মালাটা তার এত পছন্দ যে সেটাকে পাওয়ার জন্য চুরি করতেও পিছপা হয় না। এই পুঁতির মালা চুরির সময় দুর্গার মনে আকাঙ্খা নিবৃত্তির সহজ ইচ্ছে যতটা থাকে, পাপের কলুষ ততটা থাকে না। তাই দুর্গার মনে কোনও গ্লানিবোধ স্পষ্ট করে না। বাড়ির লোকের তাকে লেখাপড়া শেখানোর কোনও আগ্রহ নেই বা ভাইয়ের সঙ্গে মায়ের ব্যবহারের পার্থক্য তার মনে কোনও অভিযোগ তোলে না। পিসিকে ছাড়া তার একদ- চলে না, তার জগতে পিসির আশ্রয় নির্দিষ্ট। সে ফল চুরি করে আনে পিসিকে খাওয়ানোর জন্য, বাড়ি থেকে রাগ করে চলে গেলে পিসিকে জোর করে ডেকে আনতে যায়, পিসি বাড়ি ফিরে এলে সে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। বাড়ির সামান্য দুধটুকুরও ভাগ দেয় তার পোষা বেড়ালছানাকে। আচার খাওয়ার সঙ্গী করে ভাইকে, স্কুলে পাঠানোর সময় চুল আঁচড়ে তাকে সাজিয়ে তোলে। পুণ্যিপুকুর ব্রত করে আর বন্ধুদের সঙ্গে চড়ুইভাতি। অপুকে নিয়ে কাশবনে বেড়াতে চলে যায়, রেলগাড়ির শব্দ তার মনকে টানে, যদিও শেষ পর্যন্ত তার আর রেলগাড়ি দেখা হয় না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসে প্রাণভরে। এই দুরন্ত প্রাণবন্ত মেয়েটি পথের পাঁচালী ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র। তার মৃত্যুতে আমরা টের পাই ছবির আগাগোড়া সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে ছিল।
হরিহরের আর্তনাদ আর সর্বজয়ার ভেঙে পড়ার মুহূর্তে আমরা অনুভব করি কাহিনির কতখানি হৃদয় জুড়ে ছিল এই কিশোরীটি। হরিহরের কান্নার দৃশ্যের সাথে ডিজলভ হয়ে অপুর মাঠের প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে থাকা একাকীত্ব প্রকাশ করছে। তার মৃত্যুশোক পরিবারকে গ্রামছাড়া করে।
এটি ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সামাজিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে সমান্তরাল চলচ্চিত্রের ধারা তৈরি করে। একে ইতালির নব্য বাস্তববাদী সিনেমার ধারা বলে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীন ভারতে নির্মিত পথের পাঁচালী ছিল প্রথম চলচ্চিত্র যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়। এটি ১৯৫৫ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার লাভ করে।
এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমস্যা থাকায় নির্মাণকার্য্য ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে তা সম্পূর্ণ হয়। স্বল্প বাজেটে অপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেতার বাদক রবিশঙ্কর এই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ ব্যবহার করে চলচ্চিত্রের সঙ্গীতাবহ নির্মাণ করেন। সুব্রত মিত্র চিত্রগ্রহণ ও দুলাল দত্ত সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মে নিউ ইয়র্ক শহরের মিউজিয়াম অব মডার্ণ আর্টের একটি প্রদর্শনীতে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ও পরে সেই বছর কলকাতা শহরে মুক্তি লাভ করলে দর্শকদের প্রশংসা লাভ করে। সমালোচকরা চলচ্চিত্রটিতে প্রদর্শিত বাস্তববাদ, মানবতা ও গুণমানকে প্রশংসা করলেও অনেকে এর মন্থর লয়কে চলচ্চিত্রটির খামতি বলে মনে করেন।
পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের কোন চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি ও টীকাগুলি থেকে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তিনি ১৯৫০ সালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রার সময় এই সকল নোটগুলি লেখেন।
অপুর পাঁচালী বইতে সত্যজিৎ লিখেছেন যে তিনি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে উপন্যাসের বেশ কিছু চরিত্রকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ও গল্পটিকেও কিছুতা রদবদল করেছিলেন। উপন্যাসের শুরুর দিকেই গ্রামের মন্দিরে সকলের সামনেই ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু ঘটে, কিন্তু চলচ্চিত্রে অপু ও দুর্গা তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। চলচ্চিত্রের অপু ও দুর্গার ট্রেন দেখার জন্য দৌড়ানোর দৃশ্যটিও উপন্যাসে নেই। বর্ষায় ভিজে প্রচণ্ড জ্বর বাঁধিয়ে দুর্গার মৃত্যু ঘটে বলে চলচ্চিত্রে দেখানো হলেও উপন্যাসে মৃত্যুর কারণ অজানাই রাখা হয়েছে। হরিহর রায়ের পরিবারের গ্রাম ত্যাগ দিয়ে চলচ্চিত্র শেষ হলেও উপন্যাস সেইভাবে শেষ হয়নি।