বিশেষ প্রতিবেদক:
মঞ্চ থেকে নাটক চলে এলো টেলিভিশনে। অর্থাৎ নাটককেই ক্যামেরায় ধারণ করে শট ডিভিশন করে প্রচার হতো টিভিতে। এক্ষেত্রে সেটাই বেশি ব্যবহার হতো। এরপর এটি উৎকর্ষ ধারণ করে ধীরে ধীরে। আন্তর্জাতিক টেলিভিশনের ডেইলি সোপের মতো নাটক নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশে। প্যাকেজ নাটক, ধারাবাহিক নাটক, সাপ্তাহিক নাটকের পর এখন তা সিরিয়াল ও মেগা সিরিয়ালে রুপান্তরিত হচ্ছে। টেলিভিশন নাটকের উৎকর্ষতায় এখন তাকে টেলিভিশন ফিকশন বলছে কেউ কেউ। চলচ্চিত্রিক উপকরণ ও টেকনিক ব্যবহার করে টেলিভিশনের জন্য ছোট ছবি বানানো হচ্ছে। বানানো হচ্ছে দেড় ঘন্টার ছবিও। যেগুলোকে বলা হচ্ছে টেলিছবি বা টেলিফিল্ম। এগুলো ঠিক চলচ্চিত্র না হলেও এর কাছাকাছি গিয়ে চলচ্চিত্রের একটি আমেজ দিচ্ছে মাঝেমাঝে। আর ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে টেলিভিশন ফিকশন চলচ্চিত্রের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে এখন।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে) টেলিভিশন সার্ভিস প্রচলিত হয়। পরের বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো মুনীর চৌধুরী রচিত ও মনিরুল আলম পরিচালিত একতলা ও দোতলা নামক হাস্যরসাত্মক নাটকটি প্রচারিত হয়। এ নাটকে অভিনয় করেন লিলি চৌধুরী, ফেরদৌস আরা, ডলি ইব্রাহিম, খন্দকার রফিকুল হক ও রামেন্দু মজুমদার।
প্রথম দিকে টেলিভিশন নাটক প্রচারে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ভিটিআর সুবিধা না থাকায় যে কোনো নাট্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হতো এবং সীমিত উপকরণের মাধ্যমে নাটকের দৃশ্যপট নির্মাণ ও প্রচার করা হতো। বেশ কিছুকাল পরে ভিটিআর সুবিধা সংযুক্ত হলেও এডিটিং সুবিধা না থাকায় ধারণকৃত দৃশ্য এডিট করা হতো না। আউটডোর শুটিং তখন সম্ভব ছিল না। আউটডোরের দৃশ্যসম্বলিত সেট শিল্পীদের দিয়ে স্টুডিওতে আঁকিয়ে তার সামনে অভিনয় করানো হতো। পরবর্তীকালে অবশ্য রামপুরায় টেলিভিশনের নিজস্ব ভবন, মহড়া কক্ষের সুবিধা, একাধিক স্টুডিও ব্যবহারের সুযোগ, আউটডোর শুটিং-এ যাতায়াতের জন্য নিজস্ব যানবাহন ব্যবস্থা, দক্ষ সেট ডিজাইনার, প্রয়োজনীয় ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানের উপস্থিতি, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণের উন্নত প্রযুক্তি প্রভৃতি টেলিভিশন নাটককে অনেকটা উন্নত পর্যায়ে নিয়ে আসে। বর্তমানে কোনো টেলিভিশন নাটক সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না; স্টুডিওতে রেকর্ড করার পর প্রয়োজনীয় সম্পাদনা শেষে প্রচারিত হয়।
নববইয়ের দশক থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত টেলিভিশনের অধিকাংশ নাটক রচিত হয়েছে মানবীয় প্রেম-ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। তবে গ্রামবাংলার জীবনচিত্র, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাহিনী, শহরের নোংরা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর চিত্র, শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা, স্বল্প আয়ের ব্যক্তিবর্গের পারিবারিক দ্বন্ধ, জীবন-সংঘাত, গ্রাম্য ও শহুরে জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক কিংবা পার্থক্য নিয়ে রচিত বেশকিছু নাটক বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য এনেছে। আশি ও নব্বই দশকে জনপ্রিয় কিছু ধারাবাহিক নাটক ত্রিরত্ন, সকাল সন্ধ্যা, সময় অসময়, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, সংশপ্তক, এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই ইত্যাদি। সাপ্তাহিক নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে রক্তকরবী, ইডিয়ট, শাহজাদীর কালো নেকাব, এখানে নোঙ্গর, সুপ্রভাত ঢাকা, দূরবীণ দিয়ে দেখুন, বাবার কলম কোথায়, আয়নায় বন্ধুর মুখ, ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি। এগুলো জনপ্রিয়তায় ছিল শীর্ষে।
তবে গত কয়েকবছরে টেলিভিশন নাটকে ছিল দর্শকখরা। আকাশ সংষ্কৃতি ও সামাজিক প্রচার মাধ্যম জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ও টেলিভিশন চ্যানেলের বৃদ্ধিতে নাটকের মান কমে গিয়েছিল। দর্শক জনপ্রিয়তাও হারায় সেগুলো। তবে নতুন আঙ্গিকে টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্মের প্রচারে টিভি নাটক যা বর্তমানে টেলিভিশন ফিকশন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যেগুলো স্যাটেলাইটের পাশাপাশি ইউটিউব ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে রয়েছে ২০টিরও বেশি টিভি চ্যানেল। চ্যানেলগুলোতে ঈদের দিন থেকে প্রায় সপ্তাহব্যাপী কয়েকশ নাটক প্রচারিত হয়। এছাড়া অন্যান্য উপলক্ষ্যেও এখন নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য বা পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিকশন।
বিশেষ করে গেল ২০১৭ সালে টেলিভিশন ফিকশনে নতুনত্ব নিয়ে এসেছেন নির্মাতারা। গেল বছরে মিজানুর রহমান আরিয়ানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় বেশি প্রশংসিত ছিল নাটক ‘বড় ছেলে’। নাটকটিতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক বড় ছেলের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে পরিবারের বড় ছেলে পরিবারের অন্যদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাই উঠে এসেছে নাটকটিতে। আমাদের সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের দর্শকদের যাপিতজীবনের সঙ্গে নাটকটির কাহিনীর মিলে যাওয়ায় অনেক দর্শকই বিষাদপূর্ণ আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। নাটকটিতে বড় ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অপূর্ব, তার বিপরীতে ছিলেন মেহজাবিন। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এ নাটক জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল বলা যায়।
অন্যদিকে ঈদুল ফিতরে প্রচারিত আদনান আল রাজীবের পরিচালিত ছবিয়াল রিইউনিয়ন সিরিজের নাটক ‘বিকাল বেলার পাখি’ দর্শকের মন জয় করেছিল। মূল চরিত্রে ছিলেন অ্যালেন শুভ্র, গুণী অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, ইলোরা গহর প্রমুখ। ‘বিকাল বেলার পাখি’র গল্পে আমাদের পরিচিত নিম্নমধ্যবিত্তের চিত্রই উঠে এসেছে। সংসারজীবনে ব্যর্থ এক বাবার ভূমিকায় ফজলুর রহমান বাবু সার্থক অভিনয় করেছেন। অ্যালেন শুভ্র’র সাবলীল অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। নাটকের শেষ কথাগুলো যে কোনো মানুষের মনে দাগ কাটবে- ‘সন্তানের কাছে সবচেয়ে দুঃসহ দৃশ্যের নাম পিতার পরাজিত মুখ। এ মুখ তাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। ধ্বংস করে দেয়। জীবনের সব আয়োজন; সব ছুটে চলা; তখন তুচ্ছ মনে হয়। নগণ্য মনে হয়। সংসার তুচ্ছতার খেলা, ভালোবাসাই তার একমাত্র ভেলা।’ এ নাটক সারাবছর আলোচনায় ছিল। মানুষের মনে তা বড়রকমের স্থান করে নেয়।
নির্মাতা হিসেবে টেলিভিশনে নুহাশ হুমায়ূনের প্রথম কাজ ‘হোটেল আলবাট্রোস’। প্রথম কাজেই তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে। নুহাশ হুমায়ূনের গল্প বাছাই তার উপস্থাপনায় পরিচালক হিসেবে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অনেকদিন পর টিভি নাটকে পাওয়া গেলো আসাদুজ্জামান নূরকে। হোটেল আলবাট্রোস-এর কাহিনী লিখেছেন নুহাশ হুমায়ূন, রাশাদ ওয়াজাহাত লাতীফ ও সোমিক হাসীন। টিভি নাটকে চঞ্চল চৌধুরী খ্যাতিমান বলার অপেক্ষা রাখে না। একুশে টেলিভিশনের ‘গরিব কেন কাঁদে’ নাটকটিও দর্শকদের নজর কেড়েছে, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। পারিবারিক কাহিনী নিয়ে এর গল্প এগিয়েছে। পাশাপাশি এতে ধনী-গরিব বৈষম্যের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া রেজানুর রহমানের ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’, সালাহউদ্দিন লাভলুর ‘সোনাবানু’, তৌকীর আহমেদের ‘মেঘের আড়ালে মেঘ’ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
হাস্যরসাত্মক, আঞ্চলিকতা ও রোমান্টিকতাকে নির্ভর করেই বেশকিছু খণ্ড নাটক নির্মিত হয়েছে। এ খণ্ড নাটকের মধ্যে নজর কেড়েছে এটিএন বাংলায় প্রচারিত হানিফ সংকেতের ‘ভুল কারো না, ভুল ধারণা’ ও চয়নিকার চৌধুরীর ‘কালো চিঠি’। ‘ভুল কারো না, ভুল ধারণা’ নাটকটি হানিফ সংকেতের হওয়ায় আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন দর্শক। দেখার পর হতাশ হতে হয়নি তাদের। ঈদের ছুটিতে বিদেশ থেকে দেশে এসে এক প্রবাসী যুবকের বন্ধুর বাড়িতে ওঠা নিয়ে এগিয়েছে নাটকটির গল্প। সে বাড়িতে বন্ধুর শ্যালিকার সঙ্গে ঘটে বিচিত্র সব ঘটনা। সামাজিক মেসেজনির্ভর নাটকটি বিনোদনে ভরপুর।
‘কালো চিঠি’র মাধ্যমে দীর্ঘি পঁচিশ বছর পর পর্দা শেয়ার করেছেন শমী কায়সার, আফসানা মিমি ও মাহফুজ আহমেদ। মাসুম শাহরিয়ারের রচনায় চয়নিকা চৌধুরীর পরিচালনায় নাটকটি দর্শকরা আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন। চ্যানেল আইয়ে ঈদের দিন প্রচার হয় কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের গল্প অবলম্বনে নির্মিত নাটক ‘প্রাণবন্ত পৃথক পুরুষ’ প্রশংসার দাবি রাখে।
আয়নাবাজি সিরিজের ‘দ্বন্ধ সমাস’-এর নির্মাতা আশফাক নিপুণ। দু’টি ধর্মের একই চেহারার মানুষ ভিন্ন রূপে ধরা দেয়, তা নিয়ে সাজানো নাটকটি। যা শেষ পর্যন্ত দর্শককে বিমোহিত করে রাখে। অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, লহনা সাহা, আবুল হায়াতসহ অনেকে। আয়নাবাজি সিরিজের অন্যতম নাটক ‘মার্চ মাসের শ্যুটিং’। গল্পটি যুদ্ধের সময় পাবনার শহীদ হওয়া এক তরুণের, যে হয়তো পুনর্জন্মের মাধ্যমে তার অপেক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল অন্য কোনোভাবে। নাটকটি ছেলে যুদ্ধে যাওয়ার সময় এক মায়ের অবস্থা যেমন নিপুণভাবে তুলে ধরেছে ঠিক তেমনি হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার পর মায়ের অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে অনবদ্যভাবে। নাটকটি লিখেছেন গাউসুল আলম শাওন। নির্মাণ করেছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। মূল চরিত্রে ছিলেন অপূর্ব, নাবিলা এবং গাজী রাকায়েত।
গৌতম কৈরী পরিচালিত ‘শেষটা একটু অন্যরকম’ আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজের একটা পর্ব। আয়নাবাজি সিনেমার মূল থিম এখানে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। সেদিক দিয়ে অবশ্যই বলা যায় এই নাটক আয়নাবাজি অরিজিনাল সিরিজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অবদান রেখেছে।
ছবিয়াল রিইউনিয়ন সিরিয়ালের নাটকগুলোও দর্শকনন্দিত হয়েছে। ‘২৬ দিন মাত্র’ ছবিয়াল রিইউনিয়নের জন্য অসাধারণ রোমান্টিক ড্রামাটি বানিয়েছেন মুস্তফা কামাল রাজ। কাহিনী যেমন ভিন্ন ছিল, তেমনি ছিল গান আর অভিনয়। প্রবীণ অভিনয় শিল্পী আমজাদ হোসেন ও দিলারা জামান নাটকটিতে এতটা সাবলীল ছিলেন- এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরানো কঠিন। নাটকের গল্প ডিভোর্স আর বৃদ্ধাশ্রমকে নিয়ে, যাকে জয় করে নেয় ভালোবাসা। সেটা সন্তানের ভালোবাসা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা।
টেলিভিশন নাটক এবার পুরোপুরিভাবে টেলিভিশন ফিকশনে উন্নয়ন ঘটিয়েছে বলা যায়। কেউ কেউ বলছেন টেলিভিশনে বেশকিছু নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর স্টোরি টেলিং ছিল নিখুঁত ও ফিল্মিক- এমনটাই বলছেন অনেকে। এর ধারাবাহিকতায় টেলিভিশন ফিকশন এগিয়ে যাবে ও দেশের টেলিভিশনের উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
১ Comments
Leave a Reply
Cancel Reply
Leave a Reply
This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.
Tnx for Post