নিজস্ব প্রতিবেদক:
শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে নির্মিত চলমান চিত্র অর্থাৎ চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতি বছর ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট’ পুরস্কার দেয়া হয়। যা ‘অস্কার’ নামে খ্যাত। এই পুরস্কারকে কেন্দ্র করে বছর ঘুরে বসে বিশ্বসেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও তারকাদের মেলা। মূলত এই পুরস্কারের পদকটির নাম ‘অস্কার’। যুগের পরিক্রমায় ‘অস্কার’ নামটিই এখন পুরস্কার ও পদক দু’টোর ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়।
ধারণা করা হয়, একাডেমি লাইব্রেরিয়ান মার্গারেট হারিক এই পুরস্কার দেখে বলেছিলেন এই পদকের মানুষটি দেখতে তাঁর চাচা অস্কারের মতো, সেই থেকে এই নামকরণ। অন্য মতও আছে। ১৯৩৪ সালে ৬ষ্ঠ অস্কার প্রদানের সময় হলিউডের কলাম লেখক সিডনি সোলস্কি ক্যাথারিন হেপবার্নের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারটিকে ‘অস্কার’ বলে সম্বোধন করে ছিলেন। সেখান থেকেই এর নামকরণ।
১৯২৯ সালের ১৬ মে হলিউডের রুজভেল্ট হোটেলের ব্লজম রুমে প্রথম ‘অস্কার’ পুরস্কার দেয়া হয়। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রাচীনতম, জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী এই পুরস্কার দিয়ে থাকে একাডেমি অব মোশন পিকচার্স অ্যান্ড সাইন্স (এএমপিএএস) নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ১৯৩৫ সাল থেকে প্রিন্স ওয়াটার হাউস এই পুরস্কারের জন্য ভোট গ্রহণ করে আসছে।
১৯৩৯ সাল থেকে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অব মেরিটকে ‘অস্কার’ নামে ডাকা শুরু হয়। বিখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমজিএম-এর শিল্প নির্দেশক সেডরিক গিবসন ‘অস্কার’ পদকের নকশা করেন। এই ট্রফিতে দেখা যায় একজন নাইট ফিল্ম রিলের উপর দাঁড়িয়ে আছেন আর তার ক্রুসেডের তরবারি। লস এঞ্জেলেসের ভাস্কর জর্জ স্ট্যানলি এই নকশা অবলম্বনে ত্রিমাত্রিক ট্রফি নির্মাণ করেন।
১৯২৯ সালে প্রথম প্রবর্তনের পর থেকে আজ পর্যন্ত মোট ২৮০৯টি পদক বিতরণ করা হয়েছে। সাড়ে ১৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই পদকটির ওজন সাড়ে আট পাউন্ড। ব্রোঞ্জের এই পদকটি ২৪ ক্যারেটের সোনায় মোড়ানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ধাতুর সরবরাহ কমে যাওয়ায় তিন বছর অস্কার পদকটি রঙ করা প্লাস্টারে বানানো হয়। যুদ্ধ শেষে অবশ্য এই পদকগুলো ফেরত নিয়ে নতুন করে ধাতু ও সোনায় মোড়ানো পদক দেয়।
মাত্র ২৭২ জন লোক নিয়ে ১৯২৯ সালের ১৬ মে রুজভেল্ট হোটেলে এ পুরস্কারের সূচনা হয়েছিল। প্রথম বছরে পুরস্কারপ্রাপ্তদের তিন মাস আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, ফলে মূল অনুষ্ঠানে কোন চমক ছিল না, স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা ছিল। পরের বছর থেকে একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয়, কোন পুরস্কারপ্রাপ্তকে আগে থেকে জানানো হবে না, তবে ওই দিন সকালেই পত্রিকাগুলোকে জানিয়ে দেয়া হতো। ১৯৪০ সালে লস এঞ্জেলস টাইমস বিকালের সংস্করণে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ছেপে দেয়। এর ফলে ১৯৪১ সাল থেকে আগে ভাগে কাউকেই পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম আর জানানো হয় না। ১৯৪১ সাল থেকেই নিয়ম করা হয়, মূল অনুষ্ঠান চলাকালে খাম খুললেই কেবলমাত্র জানানো যাবে কে পুরস্কার পেয়েছেন। আজ পর্যন্ত সেই খাম খোলার চমক অটুট রয়েছে।
১৯৫৩ সাল থেকে টিভিতে ‘অস্কার’ অনুষ্ঠান লাইভ প্রচার শুরু হয়। একটি রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে যে অনুষ্ঠানের লাইভ প্রচার শুরু হয়েছিল আজ বিশ্বজুড়ে শ’খানেক দেশের টিভি চ্যানেলে এটি সরাসরি দেখানো হয়।
অস্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার হলো সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালের ছবিগুলোর মধ্য থেকে প্রথম অস্কারে কোন সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার ক্যাটাগরি ছিল না। এর বদলে দুটো পুরস্কার ছিল, একটি হলো সবচেয়ে অনন্য চলচ্চিত্র, যা পায় উইংস, অন্যটি হলো সবচেয়ে শৈল্পিক মানসম্পন্ন প্রযোজনা- যা পায় সানরাইজ। দু’টো পুরস্কারই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরের বছর একাডেমি সেরা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একটিই পুরস্কার প্রবর্তন করে যাকে তারা অনন্য প্রযোজনা নাম দেয় এবং পূর্ববর্তী উইংসকে এই ক্যাটাগরিতে ঠাঁই দেয়। এই বিবেচনায় প্রথম অস্কার প্রাপ্ত সেরা ছবি হলো ‘উইংস’। তবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারটিকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকে হয়েছে। ১৯৪১ সালে সেরা ছবির ক্যাটাগরির নামকরণ আবার বদল হয়, এখন থেকে এ পুরস্কারের নাম হয় অনন্য গতিশীল চলচ্চিত্র। ১৯৪৪ সালে এই পুরস্কারের নাম হয় শ্রেষ্ঠ গতিশীল চলচ্চিত্র। ১৯৬২ সাল থেকে এই পুরস্কারের নামকরণ হয় সেরা চলচ্চিত্র।
প্রথম বছর সেরা চলচ্চিত্রের জন্যে তিনটি ছবি মনোনয়ন পেয়েছিল। পরবর্তী তিন বছর পাঁচটি করে ছবি মনোনয়ন পায়। এটি বাড়তে বাড়তে ১৯৩৩ সালে আটটি, ১৯৩৪ সালে ১০টি এবং ১৯৩৫ সালে ১২টি চলচ্চিত্র মনোনয়ন পায়। ১৯৩৭ সাল থেকে ১০টি ছবিকে মনোনয়ন দেয়া শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সাল থেকে ৫টি চলচ্চিত্রকে সেরা মনোনয়ন দেয়া শুরু হয়। ২০০৯ সাল থেকে সেরা চলচ্চিত্রের জন্যে আবার ১০টি করে চলচ্চিত্রকে মনোনয়ন দেয়া শুরু হয়েছে। শুরুতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারটি তুলে দেয়া হতো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হাতে, ১৯৫১ সালে থেকে তা দেয়া হয় প্রযোজকের হাতে।
বর্তমানে ২৪টি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার দেয়া হয়। মজার বিষয় হলো, একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি স্টুডেন্ট একাডেমি অ্যাওয়ার্ডও দেয়া হয়। এই ক্যাটাগরিগুলো হলো: কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেতা, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেতা, কেন্দ্রীয় চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনেত্রী, সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্য, সেরা অ্যানিমেশন চিত্র (২০০১ সালে প্রবর্তিত), সেরা অ্যানিমেশন স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র, সেরা শিল্প নির্দেশনা, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা পোশাক পরিকল্পনা, সেরা পরিচালক, সেরা তথ্যচিত্র, সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র, সেরা ফিল্ম এডিটিং, সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র, সেরা মেকআপ, সেরা মৌলিক সুর, সেরা মৌলিক গান, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক কাহিনি, সেরা চলচ্চিত্র, সেরা শব্দ সম্পাদনা, সেরা শব্দমিশ্রণ এবং সেরা ভিজ্যুয়াল এফেক্ট।