রোমান কবির
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
১৯৩১ সালে জন্ম নিল আরও দুটি সিনেমা পত্রিকা। অবিনাশ চন্দ্র ঘোষালের সম্পাদিত বাংলা সাপ্তাহিক ‘বাতায়ন’ এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পথের পাঁচালী’র বিভূতি নন) সম্পাদিত ‘চিত্রলেখা’। ১৯৩২ সালে অবনী বসু শুরু করলেন মাসিক ‘চিত্রপঞ্জী’। যেখানে অন্যান্য লেখার সঙ্গে সে যুগের চলচ্চিত্রকারদের সুচিন্তিত প্রবন্ধ ছাপা হত। ১৯৩৪ সালে শুরু হল জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত সিনেমা সাপ্তাহিক ‘রূপরেখা’। প্রসঙ্গত আরেকটি পত্রিকা ওই একই বছরে চালু হয়েছিল- যা আজও চলছে। সেটি হল আনন্দগোষ্ঠীর ‘দেশ’ পত্রিকা। ১৯৩৭ সালে জগজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সিনেমা সাপ্তাহিক ‘খেয়ালীর’ প্রকাশ শুরু করলেন। ১৯৪৩ সালে কালীশ মুখোপাধ্যায় শুরু করলেন মোটামুটি উচ্চমানের একটি সিনেমা মাসিক পত্রিকা ‘রূপমঞ্চ’। এতে সে সময়কার চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদির মননশীল সমালোচনা থাকতো। সাধারণভাবে চলচ্চিত্রকলা সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা ছিল এই পত্রিকার অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই দিক দিয়ে ‘রূপমঞ্চ’ অবশ্যই একটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ছিল। যা পরবর্তীতে চলচ্চিত্র ভাবনার মোড় ঘুড়িয়ে দিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ সালে শুধাংশু বসুর সম্পাদনায় শুরু হল ‘রূপাঞ্জলী’। ১৯৪৮ সালে গৌর চট্টোপাধ্যায় সিনেমা মাসিক ‘চিত্রবাণী’ শুরু করলেন। রূপমঞ্চের মত চিত্রবাণীও সে-যুগের বোদ্ধা পড়ুয়াদের তৃপ্তির কারণ হয়েছিল।
বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম সিনেমা বিষয়ক পত্রিকা হল ‘সিনেমা’। তারপর ‘চিত্রালী’ও বেশ অনেক দিন ধরে দাপটের সঙ্গে টিকে ছিল। চিত্রালী ও সিনেমা শুধুমাত্র সিনেমাবিষয়ক পত্রিকা নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনেও পত্রিকা দুটির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সিনেমা বিষয়ক পত্রিকাগুলো সম্প্রসারিত হয় অনেক বিস্তৃতভাবে। তবে এটা স্থান পায় দৈনিক বা সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকাগুলোতে অনেকটা দায়সারা মনোভাব থেকে।
আশির দশকে এসে চলচ্চিত্র শিল্প সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে। চিত্রালী, পূর্বাণী, তারকালোক, বিচিত্রা, সিনেমা, ছায়াছন্দ, প্রিয়জন- এরকম অসংখ্য বাহারী রংঝলমলে পত্রিকা বিনোদনবুভুক্ষু পাঠকের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে। চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের সংগঠন ‘চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি’র পুরষ্কার চলচ্চিত্র শিল্পে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের জৌলুশকে ছাড়িয়ে যায়। চলচ্চিত্র শিল্প ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা আক্ষরিক অর্থেই একে অন্যের পরিপূরকে পরিণত হয়।
৬০ এর দশকে এ দেশে নির্মিত হয়েছে ভালো ভালো চলচ্চিত্র। এ সব চলচ্চিত্রের বিকাশে সহায়ক ছিল চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা। কিন্ত ৮০’র দশক থেকে এ দেশে সস্তা রুচিহীন বিনোদন ও ভাঁড়ামো স্থান পেতে থাকে। আর এ সব চলচ্চিত্রকে চটকদারভাবে পত্রিকার পাতায় তুলে ধরে চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা হয়ে উঠে মানহীন ও চটকদার চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন। প্রচারের পেছনে থেকে যায় ভালো শিল্পমানসম্পন্ন চলচ্চিত্র।
এ দেশে অনেক ভালো ভালো সিনেমা নির্মিত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে জীবন থেকে নেয়া, ওরা এগারোজন, মাটির ময়না, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, রানওয়ে, মনপুরা, জালালের গল্প, অজ্ঞাতনামা, আয়নাবাজি। কিন্তু চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা করে এরকম অনেকেরই এগুলোর দিকে কোনো দৃষ্টি নেই। তারা পত্রিকার পাতায় বাণিজ্যিক ভাঁড়ামোনির্ভর চলচ্চিত্রকে তুলে ধরে অনেকসময়। যেমন জীবন থেকে নেয়া বা স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্রের প্রচারে চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল। আর এর কারণে তা গণমানুষের সিনেমা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বই দশকে যখন অশ্লীল চলচ্চিত্রের পোষ্টারে ছেয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। তখন পত্রিকা খুললে চোখে পড়ত বড় বড় অশ্লীল ছবি আর চটকদার খবর। যা রুচিশীল মানুষকে বিব্রত করত। চলচ্চিত্র নিয়ে এরকম নেতিবাচক প্রচারণায় রুচিশীল দর্শক চলচ্চিত্র ও হলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রুচিশীল চলচ্চিত্রের প্রচারে অনেকসময়ই সাংবাদিকরা কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনা। কিছুদিন আগে জালালের গল্প নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কিন্তু দেশে এর কোন প্রচার ছিলনা। বিদেশে বেশ কয়েকটি ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পাওয়ার পর এটি দেশে পরিচিতি পায়। এর পেছনে সাংবাদিকদের উদাসীনতাই কাজ করেছে মূলত।
এছাড়া দেশের মৌলিক ভালো ছবি সম্পর্কে রিপোর্ট না লিখে পার্শ্ববর্তী সিনেমার নকল সিনেমাকে রসালো করে তুলে ধরে। যাতে পাঠকরা ভালো ছবি দেখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আবার কখনও কখনও ভাল কোনো ছবিকে নকলের তকমা লাগিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে দর্শক হারায় সেই ভাল চলচ্চিত্র। বর্তমানে শুধু চলচ্চিত্র সংবাদপত্র তেমনভাবে না থাকলেও সংবাদপত্রগুলোতে চলচ্চিত্র সংবাদ প্রকাশ ও সাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করেছে। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে অনলাইন সাংবাদিকতার প্রসার বেড়েছে। এখন অনলাইনেই চলচ্চিত্রের সব ধরণের খবরাখবর পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন অনেকগুলো সিনেমাবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা চালু আছে। সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক পত্রিকাসহ দৈনিক অনলাইন পত্রিকাগুলোতে চলচ্চিত্র সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের বিকাশে ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া বিভিন্ন ভিজ্যুয়াল মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যাণে চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সংবাদ বা চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রকাশনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্র চলচ্চিত্রের উন্নয়নে অতীতে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এখনও এ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সংবাদপত্র গ্রহণযোগ্য সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে অতীতের মত চলচ্চিত্রের বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ সুযোগে চলচ্চিত্রকে সস্তা বাণিজ্যিক উপাদান বানিয়ে কোন কোন সংবাদমাধ্যম নিজেদের মুনাফা লুফে নিচ্ছে। আর সুস্থ ধারার দর্শক হারাচ্ছে চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র শিল্প পড়ছে হুমকির মুখে। সংবাদমাধ্যমের যত বৃদ্ধি ঘটছে ততই চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সুযোগ বাড়ছে। তাই চলচ্চিত্র সাংবাদিকতাকে আরও মানসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে হবে। সংবাদপত্রের মত একটি বৃহৎ গণমাধ্যম চলচ্চিত্রের মত গণমাধ্যমের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও নেতিবাচক প্রচারণা চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংসই করবে। তাই এই দুটি গণমাধ্যমকে গণমানুষের মাধ্যম হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে একসাথেই।
চলচ্চিত্রের বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা (প্রথম পর্ব)