বিশেষ প্রতিবেদক:
এক হাতে জ্বলন্ত পাতার বিড়ি আরেক হাতে বাংলা মদের বোতল নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন জীর্ণ শীর্ণ রোগা পাতলা একটি মানুষ। পরণে পুরনো সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। এলোমেলো চুলের সঙ্গে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ঝোলা কাঁধে টলছেন আর হাঁটছেন। কেউ পরিচয় জানতে চাইলে সরাসরি জবাব ‘আমি এক মাতাল। ভাঙ্গা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল’। এ হচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক। প্রয়ানের ৪২ বছর পরও তাঁর দর্শন, তার নির্মাণ অমলিন। এই দার্শনিক চলচ্চিত্রকারের একটি ‘উক্তি ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো’, সর্বকালের সৃজনশীল নির্মাতাদের ভাবনার খোরাক জোগায়।
নিজের প্রতি উদাসীন ঋত্বিক ছিলেন শিল্প ও সমাজের প্রতি নিবেদিত। অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি। তার সিনেমা যেন এক একটি বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। তাই তাকে সিনেমার বিপ্লবীও বলা হয়। শেষ জীবনে ক্ষ্যপাটে এই মানুষটি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েই তিনি পরপারে পাড়ি জমান।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাজারে জন্ম গ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহী শহরে। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। নিজের পিতৃভূমি ছেড়ে শরনার্থী হবার মনের জ্বালা তার অন্তরে বড় ক্ষতের তৈরী করে। এর প্রভাব পড়ে তার নির্মিত সিনেমায়।
ঋত্বিক কুমার ঘটকের আরও খবর :
⇒ ঋত্বিক ঘটক: সিনেমা যার কাছে ভাঙা বুদ্ধিজীবীর প্রতিবাদের ভাষা
⇒ সিনেমার ক্ষ্যপাটে ঋত্বিক ঘটকের প্রয়ান দিবস
⇒ শুভ জন্মদিন সিনেমার পাগল ঋত্বিক ঘটক
দেশভাগ নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)’, ‘কোমল গান্ধার (১৯৬১)’ এবং ‘সুবর্ণরেখা (১৯৬২)’। এই তিনটিকে একত্রে ট্রিলজি বলা হয়। তিনি ছাত্রজীবনে ছিলেন কবি ও গল্প লেখক। এরপর তিনি যুক্ত হোন মঞ্চ আর গণ নাট্য সংঘের সঙ্গে। সেখান থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকেন তিনি। মাত্র ৫১ বছরের জীবদ্দশায় ঋত্বিক কুমার ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সবমিলিয়ে ১০টি। আরও অনেকগুলো কাহিনীচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি। এই হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।
ঋত্বিক ঘটক ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে; তিনি এই ছবিতে একই সাথে অভিনয় এবং বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এর দু’বছর পর ১৯৫৩ সালে তাঁর একক পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘নাগরিক’। দু’টি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে জোর ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি নির্মাতা হয়ে এসে তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রুপ দেন, যা মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র ও কীর্তিমান অভিনেত্রী কবরী এই ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় শেষ ছবি ‘যুক্তিতক্ক আর গপ্পো’। তাঁর সিনেমাকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন সমালোচকরা। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। আর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ১৯৭৫ সালে ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।