নুর ইসলাম:
নাটক, চলচ্চিত্র বা যে যেখানেই অভিনয় করুক না কেন, তার অভিনয় জীবনের শিক্ষাদীক্ষা, অনুশীলনের প্রথম এবং প্রধান প্রাণকেন্দ্র থিয়েটার। কেননা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ন্যায় অভিনেতা অভিনেত্রীরাও অভিনয়ের অ আ ক খ শিখে আজ এ পর্যায়। নিয়মিত অনুশীলন করা হল একজন অভিনেতার জীবন, আর অভিনয় করা হলো একজন অভিনেতার উপার্জন। জীবন যদি ঠিকভাবে চালিত না হয়, তবে উপার্জন সম্ভব? যদিও এখন অনেকেই অভিনয়গৃহ বা থিয়েটারের স্পর্শ ছাড়া টিভি নাটকে বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করছে, কিন্তু তাতে কি প্রকৃত চরিত্র উপস্থাপন হচ্ছে? বলা যায় নাটক ও চলচ্চিত্রের মার্জিত রুপ আজ ধ্বংসের মুখে। আর এর কারণ সমস্যাসংকুল থিয়েটারের নাটক।
চর্চার অভাব, শিক্ষার অভাব, চাহিদা অনুযায়ী যোগানের অভাব, চিত্রনাট্যকারের অভাব, দক্ষতার অভাব, অভাব দক্ষ অভিনয় শিল্পীর, প্রযোজকের অভাব। তবে হ্যা, চাহিদা অনুযায়ী যোগান, চর্চা, শিক্ষা, দক্ষ অভিনয় শিল্পী, চিত্রনাট্যকার, গল্পে নতুনত্ব রাখলে প্রযোজকের অভাব হবে না।
দক্ষ অভিনয় শিল্পী তৈরি করতে হলে বা পেতে হলে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় থিয়েটারকে গুরুত্ব দিয়ে অনুশীলনের ধারাবাহিকতা উন্নত করে নাট্যকর্মী সংগ্রহ অব্যাহত রাখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, এখানে কর্মজীবী বা ব্যবসায়ীরা নাট্যচর্চা করে না যে তাদের খরচ দিয়ে থিয়েটার চালাবে। আর এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের-ই আসা উচিৎ।
স্কুলে যেমন শেখানো হয় মুখের কথা গুছিয়ে বলা, তেমনি থিয়েটারে মানুষের দেহভঙ্গি, ব্যবহার, কথা বলার ধরণ শেখায়। একজন থিয়েটার কর্মী বা নাট্যকর্মী কখনো খারাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। এ আমার কথা না। এ যে “নাট্যচক্র গ্রুপ থিয়েটার সিরাজগঞ্জ” এর ১৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে নাট্যলোক থিয়েটারের সভাপতি মমিন বাবুকে গুণীজন সংবর্ধনা দেয়। অনুষ্ঠানে নাট্যলোক থিয়েটারের সভাপতি মমিন বাবু বলেন, বর্তমানের জনপ্রিয় ঘটনা, ধর্ষণ। ধর্ম, দল, জাতিভেদ, সবখানেই প্রমাণ আছে যে, অমুক ধর্মের, দল, জাতি সংগঠনের ছেলে, পুরুষ ইত্যাদি ধর্ষণ করেছে। কিন্তু, আজ পর্যন্ত কি শুনেছেন, এই থিয়েটার, ঐ থিয়েটার বা সেই থিয়েটারের কোন কর্মী কোন মেয়েকে ধর্ষণ করেছে? না। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, নাট্যকর্মী বা থিয়েটার কর্মী আজ পর্যন্ত ধর্ষণ করেনি এবং আগামীতেও করবে না। এমনকি খুন-খারাবি, চুরি ডাকাতির কাজে লিপ্ত নেই এবং আগামিতেও থাকবে না। বর্তমানে থিয়েটার সংগঠনের করুন অবস্থা। বিশেষ করে ঢাকার বাহিরে। পর্যাপ্ত জায়গার অভাব, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, দর্শক শুন্যতা, মেয়েদের প্রতি পরিবারের পিচটান ইত্যাদি ইত্যাদি এর প্রধান কারণ।
এবার কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা যাক-
১. বাংলাদেশ টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শিল্পী তৈরির জন্য মঞ্চ নাটক ছিল একটি বড় ক্ষেত্র। কিন্তু এক দশকে মঞ্চ নাটকের প্রতি অভিনয় শিল্পীদের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। এই অনাগ্রহ টেলিভিশন নাটকের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২. বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক ঢাকা শহরের কয়েকটি অডিটোরিয়ামের গন্ডি পেরিয়ে তেমন একটা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। মঞ্চ নাটকের পরিবেশনাও ঢাকা শহরের কয়েকটি অডিটোরিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
৩. টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসার এবং ইন্টারনেটের কারণে বিনোদনের নানা ধরনের মাধ্যম তৈরি হয়েছে।
৪. একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, শুধু টিকেট বিক্রি করে তা উঠে আসে না।
৫. দর্শকের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে।
৬. বিভিন্ন রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে, অন্য কোন পেশা বা বিভিন্ন উৎস হতে এসে অভিনয় জগতে জনপ্রিয় হওয়ায় নাট্যকর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে।
৭. এখন সময় ও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। কিছু ভুল ধারনাও তৈরি হয়েছে। যেমন, আপনার যদি মন চায়, তবে আপনি যেখান থেকে আসেন না কেন, আপনি ভালো করতে পারবেন।
৮.সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।
এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের উপায়-
১. মঞ্চ নাটকের প্রতি তরুণ অভিনয় শিল্পীদের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে। উৎসাহ দিতে হবে নাট্যগৃহে অভিনয় শেখার।
২. শুধু ঢাকা শহর না, বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, থানা পর্যায়ে মঞ্চ নাটকের বিস্তার লাভ করাতে হবে।
৩. টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনোদনের নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা প্রয়োজন।
৪. একটি নাটক মঞ্চস্থ করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তার আংশিক বা সম্পূর্ণ খরচ সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দিতে হবে।
৫. দর্শকের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে হবে।
৬. বিভিন্ন রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে, অন্য কোন পেশা বা বিভিন্ন উৎস হতে অভিনয় জগতে প্রবেশ রোধ করতে হবে। এতে করে নাট্যকর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
৭. শুধু সময় ও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাওয়ার কারণে সুন্দরভাবে কথা বলার মাধ্যমে অভিনয় শিল্পী হওয়া যায় না। একজন হকারও সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। শুধু কথা বলতে পারাটা অভিনয় না, দেহভঙ্গির মাধ্যমে চরিত্র উপস্থাপন করাই হল অভিনয়।
৮. স্থায়ী ও দক্ষ কর্মীদের নির্দিষ্ট হারে বেতন ব্যবস্থা করা উচিৎ। এতে করে দক্ষ কর্মীরা থিয়েটার ছেড়ে অন্য কোন পেশায় আর্থিক প্রয়োজনে কর্মের তাগিদে থিয়েটার ছেড়ে যাবে না অন্য কোন পেশায়।
৯. সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন।
উক্ত সমস্যাগুলো বিবেচনা করে যদি থিয়েটারকে গুরুত্ব দেয়া হয়, তাহলে আমরা ভালো নাটক ও চলচ্চিত্র পাবো। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে। শিক্ষা হবে, দেখা হবে, বিনোদন হবে, রাগ, হাসি, কান্না, অভিমান, বাস্তবতার উপস্থাপন, সত্য ন্যায়, ভালো মন্দ বিশ্লেষণ, বিবেককে জাগ্রত করে মানবতার সৃষ্টি হবে।