নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দীতে আয়োজিত জনসভায় নিজের স্বপ্নপূরণ করে তার কালজয়ী কবিতা আবৃত্তি করলেন একুশে পদক পাওয়া কবি নির্মলেন্দু গুণ।
এর আগে তিনি একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে তার অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শোনার। সেদিন আমি তরুণ সাংবাদিক ছিলাম। অফিসে ফিরে আমি ওই ভাষণের ওপর একটি কবিতা লিখে ফেলি। যেটি পরবর্তীকালে আমাদের পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনী গান পাউডার ছিটিয়ে আমাদের পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয়। তাই প্রথম কবিতাটি আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতির প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন তাঁকে আবৃত্তির সুযোগ দেয়ার জন্য। তিনি বলেন, যে সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ওপর কবিতা রচনা করেছিলাম, আজ সেই সোহরাওয়ার্দীর সমাবেশে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করতে পারছি। এটা আমার একটি স্বপ্ন ছিলো। লাখো মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়ে নিজের কবি পাঠ করার সৌভাগ্য সম্ভবত আমার আগে আর কারও হয়নি।
এরপর কবিতা আবৃত্তি শুরু করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতাটি পুরোটা তুলে ধরা হলো-
‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে- ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে
হয়েছে উদ্যত কালো হাত।
তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…।
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে,- আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর;
না পার্ক না ফুলের বাগান,- এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশে ছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল
কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক, লাঙল জোয়াল কাঁধে
এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক, পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে
এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক, হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে
এসেছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা,
ভবঘুরে আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য সে কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা- ;
কে রোধে তাঁহার বজ্র কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শুনলেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।