রোমান কবির:
চল্লিশের দশকে ইতালিতে চলচ্চিত্রের এক নতুন ধারা তৈরি হয়, যা নব্য-বাস্তববাদ বা নিও রিয়েলিজম নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এ ধারায় প্রভাবিত হযে পরবর্তীতে আকিরা কুরোসাওয়া, আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও সত্যজিত রায়সহ বিশ্ববিখ্যাত সিনেমা নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ ধারার শুরুর দিকে ইতালির একটি সিনেমা লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে বা দ্যা বাইসাইকেল থিফ। ভিত্তোরিও দে সিকা ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।
ছবিটির সম্পর্কে বলার আগে একটু আলোচনা করা যাক নব্য-বাস্তববাদ নিয়ে। এ ধারার ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-দরিদ্র, কর্মজীবি শ্রেণির বিভিন্ন মানবিক দিক নিয়ে এর কাহিনী আবর্তিত হবে। এর চিত্রধারণ হবে সংশ্লিষ্ট কর্মজীবি মানুষদের বাস্তব লোকেশনে। আর অভিনয় শৈলী ফুটে উঠে বাস্তব ও অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে। এ ধারা অনুযায়ী বাইসাইকেল থিফ একটি নব্য-বাস্তববাদী সিনেমা। একে নব্য-বাস্তববাদী সিনেমার পথপ্রদর্শকও বলা যেতে পারে।
ছবিটি ইতালির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী তৎকালীন সময়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এ ছবিতে পুঁজিবাদী সমাজ বাস্তবতায় একটি বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক চিত্র ফুটে ওঠে একটি পরিবারের কাহিনীর মধ্য দিয়ে। বার্তোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে ছবির চিত্রনাট্য লেখেন সিসারে জাভাত্তিনি।
ছবিটির কাহিনী গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির রোম শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে। এক নিন্ম মধ্যবিত্ত শহুরে পিতা সংসারের খরচ চালাতে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। এক সময় একটি ছোট চাকরি পায় সে। বিজ্ঞাপনের পোস্টার লাগানোর চাকরি। কিন্ত এই কাজ করতে হলে তার একটি সাইকেল লাগবে। আন্তোনিও রিচ্চি তার স্ত্রী মারিয়াকে এ কথা বললে তাদের বিয়েতে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত বিছানার চাদরগুলো বন্ধক রেখে একটি সাইকেল নেয় তারা। সাইকেল পেয়ে খুশিমনে স্বামী-স্ত্রী বাড়ি ফিরে। সাইকেলের ক্রসবারে স্ত্রীকে বসিয়ে আন্তোনিও বাড়ি ফিরছে। অল্প পেয়েই খুশি নিন্মবিত্ত স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক চিত্র।
এর মধ্যেই মারিয়া এক ভবিষ্যতদ্রষ্টা মহিলার কাছে যায় স্বামীকে নিয়ে। সেই মহিলাটি মারিয়াকে বলেছিলো তার স্বামী চাকরি পাবে। সে জন্য টাকা দেয় সে। নিন্ম মধ্যবিত্তদের বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে একশ্রেণির ভবিষ্যত দ্রষ্টার ব্যবসাপাতি নব্য-বাস্তববাদী সিনেমার রুপায়ন।
সাইকেল নিয়ে প্রথম দিন আন্তোনিও তার পুত্র ব্রুনোকে নিয়ে কাজে যায়। ব্রুনোকে তার কাজে নামিয়ে নিজের কাজে যায়। মইয়ের উপর ওঠে পোস্টার লাগাচ্ছে আন্তোনিও। এ সময় এক যুবক তার সাইকেল চুরি করে। আন্তোনিও তার পিছে তাড়া করে কিন্তু চোর তাকে ধোঁকা দিয়ে পালায়। শুরু হয় ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে আন্তোনিও’র সাইকেল খোঁজা অভিযান। এ অভিযান নিয়েই ছবিটি এগোয়।
সাইকেল খুঁজতে পুলিশের কাছে গেলেও তারা কিছু করতে অপারগতা জানায়। নিন্মবিত্তদের জন্য পুঁজিবাদী সমাজে এভাবেই আইনী সেবা। তার এক বন্ধুর সহায়তা্য় পিয়াজ্জা ভিত্তোরিও নামক বাজারে যায় সে। যেখানে চুরিকৃত সাইকেল বিক্রি হয়। কিছু বন্ধু ও ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে সাইকেলের খোঁজে যায় সে। সাইকেলের পার্টস পরীক্ষা করে দেখে। এর মধ্যে একটি সাইকেল নিজের মনে হলেও সাইকেলের নম্বর মিলে না। মন খারাপ করে ফিরে আসে। খুঁজতে খুজতে আবারও চোরের দেখা মিললেও আবার মিলিয়ে যায় সে।
এ অভিযানে ক্লান্ত শ্রান্ত বাবা-ছেলের মধ্যে যে অভিমান ও ভালোবাসা এর একটি পর্ব এমন। ক্লান্ত ব্রুনো আর এগোতে চায়না। আন্তোনিও একসময় থাপ্পর বসিয়ে দেয় ছেলের গালে। কান্নারত ব্রুনো দুরে দুরে হাঁটতে থাকে। ব্রুনোকে একটি পুলের উপর বসিয়ে আবারও চোর খোঁজা। নিজেদের সারাদিনের সাইকেল অভিযানের একপর্যায়ে ছেলের অভিমান ভাঙাতে একটি দামি রেস্তোরাঁয় ঢুকে তারা। দুপুরের খাবার খেতে খেতে পাশেই দেখে একটি ধনী পরিবার উন্নত খাবার খাচ্ছে। যেখানে শুধু ছেলের জন্য একটি খাবারের অর্ডার দেয় সে।
হতাশাক্লিষ্ট আন্তোনিও সেই মহিলা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার কাছে যায়। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা তাকে সাইকেল খুঁজে পাবার আশ্বাস দেয়। আজ না পেলে আর কখনোই পাবেনা এমনটাই বলে। আবারও চোরকে খুঁজে পায় বাবা-ছেলে। একটি পতিতালয়ে চোরকে পায়। কিন্তু সাইকেল পাওয়া যায়না।
ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসতে আসতে এক ফুটবল স্টেডিয়ামের সামনে দেখে স্তাদিও নাজিওনেল পিএনএফ এ খেলা চলছিল এবং বাইরে সারিবদ্ধ সাইকেল তাদের মালিকের জন্য অপেক্ষায়। আর একটি বাড়ির দরজার কাছে সারি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি সাইকেল। কিছুক্ষণ টানা উত্তেজনাকর পদচারণা। মাথার টুপি খুলে বসে পড়লো ছেলের সঙ্গে। ছেলেকে কিছু পয়সা দিয়ে ট্রামে চেপে বসতে বললো। এরপর আবারও অস্থির পায়চারি। খেলা শেষ হলে সাইকেল নিয়ে সারিবদ্ধ চললো সবাই। এ সুযোগে বিচ্ছিন্ন সাইকেলটি চুরি করে নিয়ে পালাতে থাকলো আন্তোনিও।
কিন্তু বিধিবাম লোকজন তাকে ধরে ফেললো। ব্রুনো ভিড়ের মধ্যে তার বাবাকে আবিস্কার করে। সবাই যখন আন্তোনিওকে মারছে তখন ছেলে সবার কাছে কেঁদে কেঁদে অনুনয় বিনয় করে বাবাকে ছেড়ে দিতে বলে। সবাই আন্তোনিওকে ছেলের অনুরোধে ছেড়ে দেয়। আন্তোনিওর টুপি নিচে পড়ে যায়। এটি ছেলে তুলে ঝেড়ে বাবার হাতে দেয়। ক্ষুদ্ধ অপমানিক আন্তোনিও হাটতে থাকে। ছেলে ব্রুনো বাবার হাত ধরে সামনে এগিয়ে যায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে আন্তোনিও নিজের কান্না চাপিয়ে রাখতে পারেনা। ছেলের হাত ধরে শহরের হাজারও মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায় তারা। এরকম অনেক নিন্মমধ্যবিত্তদের কষ্ট চাপা থাকে যেন এ সব শহুরে মানুষদের ভিড়ে।
১৯৪৮ সালের ২৪ নভেম্বর ইতালিতে এবং ১৯৪৯ সালের ১২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায় ছবিটি। ১৯৫০ সালে অস্কার পায় ছবিটি।
লেখক: সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা