![চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ৪৭ বছর](https://culturalyard.com/wp-content/uploads/2018/03/Film-2.jpg)
আপন চৌধুরী :
মহান স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মহত্তম অধ্যায়। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে অনেক পরিচালক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। কেউ সফল হয়েছেন, কেউ বা ব্যর্থ। কাঁচাপাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে আসা পাকিস্তানি সৈন্য ভর্তি ট্রাকে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বোমা বর্ষণ, অসহায় মা-বোনদের উপর পাকিস্তানি মিলিটারি কর্তৃক ভয়াবহ নির্যাতন, রাজাকারের দৌরাত্ম, অবশেষে মুক্তিবাহিনীর বিজয় দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন দৃশ্যপট ভেসে উঠে ইতিহাসের পাতায়। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য দেশ বরেণ্য পরিচালক জহির রায়হান নির্মাণ করেন স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১)। এদেশে গণহত্যা কেমন হয়েছিলো তার সচিত্র প্রতিবেদন স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১)। এর নির্মাণ শৈলীর শিল্পগুণ হয়ত কেউ বিচার করেনি। কারণ বাঙ্গালির গণহত্যার সেই বিভৎস চিত্রের কোন নান্দনিক বর্ণনা কলমে লেখা যায় না। এগুলো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিত্রায়িত।
যুদ্ধের ভয়াবহতা, প্রাণ বাঁচানোর আশায় অসহায় মানুষের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণের চিত্র বাস্তব ও মর্মস্পর্শী হয়ে ফুটে উঠেছে এ ছবিতে। নির্মাণ শৈলীতে নির্মাতা এতে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছিলেন প্রামাণ্যচিত্রের প্রবাদ পুরুষ রবার্ট ফ্লাহার্টিকে। জহির রায়হান বিষয়ের মহত্ত্ব এবং মানবিকতার জয়গানে তাকেও যেন ছাড়িয়ে গেলেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র কীর্তি।
স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়। জহির রায়হান এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) নামে আরও একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে মানচিত্র হয়েছিলো সেটিই এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) । এটি তৈরি করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে। এছাড়া আলমগীর কবির তৈরি করেন প্রামাণ্যচিত্র লিবারেশন ফাইটার্স (১৯৭১)। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সাউন্ডট্রাকে ওভারল্যাপ করে এ ছবিতেই প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে । বাবুল চৌধুরীর প্রামাণ্যচিত্র ইনোসেন্ট মিলিয়নস্ (১৯৭১) এর বিষয়বস্তু নারী ও শিশুদের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে প্রথম সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। যুদ্ধকালীন সম্পূর্ণ চিত্র দর্শকদের সামনে তুলে ধরে তাদের শিহরিত করেন ওরা ১১ জন (১৯৭২) ছবি দিয়ে।
১১ জন মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা, সংগঠিত হওয়া, যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে এই ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। পরিসমাপ্তি হয় শত্রুবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয় উল্লাসের মাধ্যমে। একই বছর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের অরুনোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী (১৯৭২)। এর প্রেক্ষাপট ছিল ব্যতিক্রম। ছবির অভিনেতা যুদ্ধে যেতে পারে না, অসহায়ের মত লক্ষ্য করে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা। একই সময়ে মুক্তি পায় আনন্দের বাঘা বাঙালি (১৯৭২) ও মমতাজ আলীর রক্তাক্ত বাংলা (১৯৭২)। ছবি দু’টিতে নারীদের অশ্লীলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরের বছর আলমগীর কবির নির্মাণ করলেন ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)। এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাহিনীচিত্র হলেও এতে প্রামাণ্য ও ফিকশনের সংমিশ্রনে সফল হন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনদেশে কিছু অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা প্রকাশ পেল খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) ছবিতে। একই বছর মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে আলমগীর কুমকুম নির্মাণ করলেন আমার জন্মভূমি (১৯৭৩), কবির আনোয়ার স্লোগান (১৯৭৩)। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও চোরাকারবারীদের সমসাময়িক চিত্র তুলে ধরে নারায়ণ ঘোষ মিতা নির্মাণ করেন আলোর মিছিল (১৯৭৪)। এর মাধ্যমে পরিচালক দর্শকদের মনে দেশপ্রেমের নতুন দীপ শিখা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। একই বছর চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় চলচ্চিত্র সংগ্রাম (১৯৭৪) মুক্তি পায়। হারুন-অর-রশিদ মেঘের অনেক রং (১৯৭৬) নির্মাণ করে দর্শকদের অনেকের মনেই রং ছড়িয়েছেন। আব্দুস সামাদ তৈরি করেন সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬), সূর্যসংগ্রাম (১৯৭৭)।
এরপর দীর্ঘ নীরবতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দু’একটি বিচ্ছিন্ন প্রয়াস ছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর শিল্পমান ও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক নয়। চলচ্চিত্রের গুণগত মানের বিচারে এগুলোর অবস্থান বিবেচনা করাটা মুখ্য নয়। নির্মাতারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ছবিতে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিভার ঘাটতির জন্য হয়ত শিল্পমানে মার খেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মত এতবড় একটি ঘটনার প্রতি চলচ্চিত্রকাররা কেন এত উদাসীন?
সত্যিকারের প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতার অভাবও একটা কারণ। প্রতিভাবান হয়তো আছেন কেউ, কিন্তু নেই তার অর্থবল। স্বাধীনতার পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের অবস্থান কোথায় এমন প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই অজানা। যেখানে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ৫৫ বছর পর ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ নির্মাণ করেন মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র বার্থ অব এ নেশন (১৯১৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৫০ বছর পরও স্টিভেন স্পিলবার্গ তৈরি করেন অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র সিন্ডার্স লিস্ট (১৯৯৩)। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয় মাত্র ৪টি চলচ্চিত্র। পরের বছর আরও ৪টি। ১৯৭৪ সালে ২টি। ১৯৭৬ সালে ২টি। ১৯৭৭ সালে ১টি।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শহীদুল হক খান নির্মাণ করেন কলমীলতা (১৯৮০), কাজী হায়াৎ সিপাহী (১৯৯৩)। হুমায়ূন আহমেদ আগুনের পরশমনি (১৯৯৪) নির্মাণ করে নন্দিত হন। ১৯৭১ সালে আমেরিকান সাংবাদিক লিয়ার লেভিন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে ঘুরে ঘুরে তাদের কার্যক্রমের উপর ২০ ঘন্টার দৃশ্যধারণ করেছিলেন। কিন্তু তা ২৩ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে বাক্সবন্দি হয়ে পড়েছিল অর্থসংকট এবং লেভিন বাংলা বুঝতে পারেন নি বলে। স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদকে সঙ্গে নিয়ে তারেক মাসুদ সেগুলো উদ্ধার করে সম্পাদনার পর ৮০ মিনিট দৈর্ঘ্যের মুক্তির গান (১৯৯৫) চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন। তারেক মাসুদের অনেক শ্রম ও ঘাম দিয়ে গড়া ‘মুক্তির গান’ এখনও অনেককে নাড়া দেয়। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক মহৎ প্রামাণ্য দলিল এবং প্রথম রঙ্গিনচিত্র।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম তার তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭) নির্মাণ করেন। এটি পুরস্কৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন গেরিলা (২০১১)। দেশে-বিদেশে এই ছবিটির পুরস্কার অর্জন এবং দর্শক আগ্রহের কথা প্রায় প্রত্যেকেরই জানা। এই সময়ে মোরশেদুল ইসলাম জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ নিয়ে নির্মাণ করেন আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) নামের কিশোর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এটিও দর্শক প্রিয় হয়। খুলনার চুকনগরের গণহত্যা নিয়ে তানভীর মোকাম্মেল নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জীবন টুলি (২০১৪)।
মূলধারার চলচ্চিত্রের হতাশার পাশে আশার আলো দেখাচ্ছে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র। অনভিজ্ঞ, অস্বচ্ছল একদল মেধাবী উদ্দ্যমী তরুণ প্রায় পরিত্যক্ত ১৬ মি: মি: ক্যামেরা আর প্রজেক্টর সম্বল করে এর গোড়াপত্তন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই এদের প্রধান সম্বল। এর মধ্যেই ওদের অনেকে ছিনিয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। মোরশেদুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি আগামী (১৯৮৪)। এটি ১৯৮৫ সালে দিল্লি চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রৌপ্য ময়ূর’ লাভ করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নির্মিত যে সব পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আমাদের চেতনায় ও জাগরণে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান করেছে সেগুলো হলো: নাসির উদ্দিন ইউসুফের ৭১ এর যীশু (১৯৯৩), হারুনর রশিদের আমরা তোমাদের ভুলবো না (১৯৯৩), বাদল রহমানের ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ (১৯৯৮), শামীম আক্তারের ইতিহাস কন্যা (২০০০), শিলালিপি (২০০২), রিনা ব্রাউন (২০১৬), নাদিম মাহমুদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশ (২০১২), মাসুদ আখন্দের পিতা (২০১২), শাহাজান চৌধুরীর আত্মদান (২০১২), জাহিদুর রহিম অঞ্জনের মেঘমল্লার (২০১৪), শাহ আলম কিরণের ৭১ এর মা জননী (২০১৪), সাদেক সিদ্দিকীর হৃদয়ে ৭১ (২০১৪), মান্নান হীরার ৭১ এর ক্ষুদিরাম (২০১৪), তানভীর মোকাম্মেলের নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৪), চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৯), রাবেয়া (২০০৮), মোরশেদুল ইসলামের খেলাঘর (২০০৬), অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫), খান আতাউর রহমানের এখনও অনেক রাত (১৯৯৭), শহিদুল ইসলাম খোকনের লাল সবুজ (২০০৫), চাষী নজরুল ইসলামের মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রুবতারা (২০০৬), হুমায়ূন আহমেদ এর শ্যামল ছায়া (২০০৪), তৌকির আহমেদের জয়যাত্রা (২০০৪), মিজানুর রহমান শামীমের ৭১ এর গেরিলা (২০১৪), মনসুর আলীর সংগ্রাম (২০১৫), নূরুদ্দীন মোঃ তাহের শিপনের একাত্তরের নিশান (২০১৬), বি এম সালাউদ্দিনের একজন মুক্তিযোদ্ধা (২০০১), খিজির হায়াতের অস্তিত্বে আমার দেশ (২০০৭), রুবাইয়াত হোসেনের মেহেরজান (২০১১) সোহেল আরমানের এইতো প্রেম (২০১৫), মুশফিকুর রহমান গুলজারের লাল সবুজের সুর (২০১৬) এবং ফকরুল আরেফিনের ভুবন মাঝি (২০১৭)। পরিসংখ্যানে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধের পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তিপায় ২০১৪ সালে সর্বাধিক ৬টি (১৯৭২-২০১৭ পর্যন্ত সময়ে)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের নির্মাতাদের ভাবনা নিয়মের বেড়াজালে বন্দি থাকলেও বিদেশীরা কিন্তু থেমে থাকেন নি। তাদের সেলুলয়েডের ফিতায়ও বন্দি হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা শুকদেব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি করেন নাইন মান্থস অব ফ্রিডম (১৯৭১)। ভারতীয় পরিচালক আইএস জোহর নির্মাণ করেন জয় বাংলা (১৯৭২)। ব্রিটিশ টিভি চ্যানেল পাগডার উদ্যোগে নির্মিত হয় মেজর খালেদ’স ওয়ার (১৯৭২)। জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগাশি ওশিমা তৈরি করেন বাংলাদেশ স্টোরী (১৯৭২)। মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই অবলম্বনে ভারতের গীতা মেহতা ডেটলাইন বাংলাদেশ (১৯৭২) এবং দূর্গাপ্রসাদ দুরন্ত পদ্মা’য় (১৯৭২) চিত্রিত করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে। ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝিতে ব্রিটিশ টিভি নেটওয়ার্ক চ্যানেল-৪ এর উদ্যোগে গীতা সায়গল ও ডেভিড বার্গম্যান তৈরি করেছেন ওয়ারক্রাইমস ফাইল। ভারতীয় নির্মাতা মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত করেন যুদ্ধশিশু (২০১২) নামে বীরাঙ্গনাদের জীবন কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র। এটি বেশ প্রশংসিত হয়।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের শত বছর পার হয়েছে অনেক আগেই। মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) থেকে ধরলে আমাদের চলচ্চিত্রের বয়স ৬২ বছর। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর। ৬২ বছরেও আমাদের চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে এখনও শৈশবে পড়ে আছে। অন্যদিকে প্রযুক্তি আর অগ্রসর বিজ্ঞান ভাবনায় বিশ্বচলচ্চিত্র চলে গেছে অ্যাভাটার (২০০৯) পর্যায়ে। আমাদের সামনেও আছে অমিত সম্ভাবনা। আছে হাজার বছরের সংগ্রামী ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক ভিত্তি এবং মুক্তিযুদ্ধে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান – ভারত নামে দু’টি রাষ্ট্র গঠিত হলে তখনকার পূর্ববঙ্গ পাকিস্থানের অংশ হিসাবে পূর্ব পকিস্তান নাম লাভ করে। ১৯৫৪ সালে সরকারী উদ্যোগে প্রাদেশিক চলচ্চিত্র ইউনিট গঠিত হয়। ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল তৎকালীন শিল্প, বানিজ্য ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী পরে বাংলাদেশে জাতির জনক, রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সংসদে বিল উত্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্থান চলচ্চিত্র সংস্থা’ গঠিত হয়। এতে পূর্ব বঙ্গের শিল্প সংশ্লিষ্ট মানুষের ছবি নির্মাণের পথ প্রশস্ত হয়। মুখ ও মখোশ (১৯৫৬) থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এদেশে ৩৩৫২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৩০৫০ এর উপরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় ৫০টির উপরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বছরে দু’একটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি মুক্তি পেলেও তাতে মুক্তিযুদ্ধের তেমন কোন নান্দনিক উপাদান থাকে না বললেই চলে।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর অনেক কিছু না পেলেও পেয়েছি সবচেয়ে বড় সম্পদ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পেয়েছি মুক্তভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বাধীনতা। এখনকার তরুণরা অনেক শিক্ষিত এবং চলচ্চিত্র বিষয়টি তারা খুব ভালো বোঝে। ব্যবহারিক শিক্ষার অভাব থাকায় সেই ভালো কাজগুলো বের হচ্ছে না। সুখবর হলো সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেছে ২০১২ সালে এবং চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে ২০১৩ সালে। এর মাধ্যমে বের হবে ভাল নির্মাতা, যারা সমৃদ্ধ করবে আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকে। যখন তত্ত্বজ্ঞান এবং ব্যবহারিক শিক্ষা একসঙ্গে মিলিত হবে তখন আগ্রাসন দূর হবে এবং যুগোপযোগী চলচ্চিত্র তৈরি হবে। চলচ্চিত্র মাধ্যম আর্টের একটি অঙ্গ। এর জন্য দরকার সাধনা। চলচ্চিত্রের আর্টকেও যেমন বাঁচিয়ে রাখতে হবে আবার এর অর্থনৈতিক বিষয়টিকে বাদ দিলে চলবে না। দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি কালচার তথা চলচ্চিত্র অনেকাংশে নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার উপর। যদি আমরা স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে সাজিয়ে তুলতে পারি; তবে শুধু চলচ্চিত্র নয়, দেশের সংস্কৃতিও সোনার বাংলার মতোই সুন্দর হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
১ Comments
Leave a Reply
Cancel Reply
Leave a Reply
This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.
ভাই মনে হয় ছবিগুলি না দেখেই লিখেছেন। কবির আনোয়ারের ‘স্লোগান’ (১৯৭৩) ও আব্দুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ (১৯৭৬) ও ‘সূর্যসংগ্রাম’ (১৯৭৯) ছবি তিনটি ইউটিউবে পাওয়া যা, দয়া করে দেখে তারপর একটু বলেন এগুলো কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের ছবি।