নুর ইসলাম :
গত ৩ এপ্রিল ছিলো জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস। এর আগের রাতে কথা হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক রোমান কবির ভাইয়ের সঙ্গে। চলচ্চিত্র দিবস উপলক্ষে বিএফডিসিতে থাকবেন তিনি। যেতে বললেন। কথা দিয়েও সময় মতো যেতে পারিনি। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ৬টা। বের হলাম উদীয়মান নাটক অভিনেতা সাফিন সরকার প্রকৃতকে সাথে নিয়ে। লক্ষ্য বিএফডিসি। ফোন দিলেন পরিচালক তানিম বিন সিদ্দিক। ফার্মগেট এসেছিলেন। সাফিনসহ তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। কথা, আড্ডা, চা খাওয়া শেষে রিক্সায় রওনা হলাম বিএফডিসির উদ্দেশ্যে। অন্যরকম এক অনুভূতি। উত্তেজনায় দম বন্ধ হওয়া অবস্থা। কারণ জীবনে প্রথম বিএফডিসিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
মনের মাঝে আনন্দ আর ভয়। প্রথম বিএফডিসি ভ্রমণ বলে কথা। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রিক্সা বিএফডিসি’র সামনে দাঁড়াল। তানিম বিন সিদ্দিক ভাই রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিতেই তিনজন এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, `ভাই, ভিতরে যাবেন, আমাকে একটু সাথে নিয়ে যান না, প্লিজ ভাই, আজকের জন্যে একটু হেল্প করেন’। বাকি দুজনও ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিল। ভাড়া দিতে দিতেই তানিম ভাই বলল, `ভুলে আমার গেটপাস বাড়ীতে রেখে এসেছি। আমিই যেতে পারছিনা, আপনাদের নিব কি করে?’।
একে একে সকলে যে ভিড় করছিলো, তাতে আমরা বাধ্য হলাম কারওয়ান বাজারের দিকে হেঁটে যেতে। এসে রেল লাইনের উপরে দাঁড়ালাম। ভাইকে বললাম, `আপনিই যেতে পারছেন না, তাহলে আমরা যাবো কি করে?’। তানিম ভাই বলল, `চিন্তা নেই, শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে, আমরা যেতে পারবো।’। মনে মনে ভাবলাম, যাক, এবার তাহলে নিশ্চিত বিএফডিসিতে প্রবেশ করতে পারবো। এমন সময় একটা সুন্দরী মেয়ে তানিম ভাইয়ের কাছে এসে ভিতরে যাওয়ার জন্য সাহায্য চাইলো। দেখে আমার খুব পছন্দ হল।
ভাই না করে দিতে বাধ্য হলো। আবার চলে এলাম বিএফডিসির প্রধান গেটে। শাহরিয়ার মাইক্রো করে ভেতরে প্রবেশ করলো, কিন্তু আমাদের যাওয়া হচ্ছে না। শাহরিয়ার আর তানিম ভাইয়ের মধ্যে একটু পর পর মোবাইলে কথা হচ্ছে। এই আসছি, আসছি… বলে তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে তিনজন গেটের সামনে। তারা দুইজন তো অপেক্ষায় ভেতরের দিকে তাকিয়ে আছে।
আর আমি দেখছি কত মানুষের স্বপ্ন। একটাই স্বপ্ন ভেতরে প্রবেশ করা। যে চিন্তা মুখে প্রকাশ হচ্ছে ভিতরে না যাওয়ার কষ্ট। না জানি কত স্বপ্ন বুকে লালন-পালন করছে। একদিন সে ভালো নামকরা অভিনেতা বা অভিনেত্রী হবে, কত যে স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণ করে এরকম ভাল-ই কয়েকজনকে দেখলাম, দু’একজনের কথোপকথনে বুঝলাম, তারা চলচ্চিত্রে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছে। হয় তো কুলি, দিন মুজুর, নায়িকার পা ধুয়ে দেবার সেবিকা, কিংবা ছোট খাটো একটা করে পলক দৃশ্যে অভিনয় করে কিছু টাকা পেয়েছে কিংবা তাও পায়নি। একটু পর পর কল দিয়ে যাচ্ছে মোবাইলে, `স্যার, একটু গেটে আসেন, আমি ভিতরে যেতে চাই। ভাই একটু নিয়ে যান ভিতরে যেতে পারছিনা। ম্যাডাম একটু কাউকে পাঠান না, আমি আপনার সাথে দেখা করবো। আমাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।’ এবার আমার খারাপ লাগছে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল বিএফডিসিতে ঘুরে দেখার, তা কি আজ কপালে নেই?
মনে পরলো রোমান কবির ভাইয়ের কথা। দ্রুত কল দিলাম কিন্তু রিসিভ হলো না। এবার কি আমায় সত্যি সত্যি ফিরে যেতে হবে? এত্ত এত্ত সুন্দর ছেলে সুন্দরী মেয়েরা বিএফডিসি’র সামনে ভিড় করেছে যে, তাদের কাছে বিএফডিসি যেন স্বর্ণমুকট! সত্যি তাই।
ভাবছি সাফিন, তানিম ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো। এমন সময় রোমান কবির ভাইয়ের কল এলো। শান্তির পরশ ছুঁয়ে গেল হৃদয় জুড়ে। ভাইয়ের সাথে প্রবেশ করলাম আমরা তিনজন বিএফডিসিতে। একটা স্বপ্ন পূরণ হলো।
নির্মাতা রোমান কবিরের সাথে লেখক
আমরা না হয় রোমান কবির ভাইয়ের মাধ্যমে প্রবেশ করলাম, কিন্তু তাদের কি হবে, যারা বিএফডিসিতে প্রবেশ করার জন্য পাগল হয়ে আছে?
দুর্ভাগ্য। কিছু দুর এগিয়ে যেতেই বুঝলাম দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেদিকে না তাকিয়ে গিয়ে বসলাম প্রযোজক সমিতির সামনে।
তানিম ভাই ব্যক্তিগত কাজ থাকায় অন্য দিকে গেল। সাফিনও তার সাথে। কিছু সময় আড্ডা দেওয়ার পর মনে হল, যেহেতু প্রথম এলাম, কোথায় কি আছে তা না দেখলে কেমন হয়? আর হ্যাঁ, প্রবেশ পথে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে মিতুল ভাই। মিতুল এবং রোমান ভাইকে রেখে বের হলাম বিএফডিসি ঘুরে দেখার জন্য।
জহির রায়হান ল্যাবরেটরি, মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক জসিম ভবন, পরিচালক ভবন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, এটিএন ভবন ইত্যাদি। মাঝে মাঝে দু’একজনকে দেখতে পেলাম এমন যে, যারা শুধু মাত্র অভিনয় করার জন্য পাগল। কে কার পিছে ঘুরছে, তা না বলা ভালো মনে করি। সফল হোক তাদের চিন্তা ভাবনা, সফল হোক পরিশ্রম। মঞ্চে দুইটা গান দেখে চলে এলাম প্রযোজক সমিতির সামনে, যেখানে রোমান ভাই এবং মিতুল ভাইকে রেখে গিয়েছিলাম। এসে দেখি পরিচালক নিহাজ খান। পরিচিতি হলাম। চলছে কথোপকথন। নিহাজ খান `এক পলক ভালবাসা’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে।
গল্পসংক্ষেপে এ আমি নিশ্চিত যে এই চলচ্চিত্র বাংলাদেশ এবং কলকাতায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। তার প্রতি আমার শুভকামনা রইলো। কিছু সময় পর নিহাজ খান ভাই বিদায় নিল ব্যস্ততার কারণে। একটু মোড় নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে এক সময় দেখলাম, সনি রহমান দাঁড়িয়ে নিজ অভিনয় করা চলচ্চিত্র তোলপাড়’র ট্রেইলর দেখছে বড় পর্দায়। তাকে ঘিরে ৭/৮ জন দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত নিজেদের মানুষ। যা হোক, ফ্যাশন শো চলছে। আমরা মঞ্চের দিকে যাচ্ছি। যাওয়া মাত্র ফ্যাশন শো শেষ হয়ে গেলো।
অভিনেতা ফেরদৌস জানতে চাইলো, `আপনারা প্রথমে কার নাচ দেখতে চান?’। সকলে উচ্চ কন্ঠে এক সাথে পপি পপি বলে শোরগোল করছে।
কয়েক মিনিট বিরতি। আসলে কতটা সাধনা আর পরিশ্রম করলে মানুষের মনে নাম স্থান পায়, তা আজ বাস্তব নিজ চোখে দেখলাম। হয়তো না গেলে বুঝতেই পারতাম না, কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বিএফডিসি স্বর্ণমুকুট! অবিশ্বাস আর মিথ্যা মনে হতো বিএফডিসি সম্পর্কে। আজ স্বচক্ষে দেখলাম। অবশেষে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পপি’র নাচ দেখে বিদায় নিলাম পরিচালক রোমান কবির ভাইয়ের কাছ থেকে।