জাহিদ মজুমদার :
‘তুমি আমার’ অপুর উদ্দেশ্যে বলা শুভ্রার এই অধিকার নিয়ে বলা প্রেমের আকুতি মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আমার দেখা প্রেমের বাংলা সিনেমার সেরা ডায়ালগ এটি। শুভ্রা চরিত্রের পরীমনি প্রেমিকের প্রতি যে আবেগের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে তা দারুণ ছিলো। রাগ, দু:খ, অভিনয় আর হাসির জালে দর্শককে বন্দি করেছেন পরী। আর বাংলা চলচ্চিত্রে পরীকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম।
মনপুরা খ্যাত পরিচালক স্বপ্নজালে শুভ্রা-অপুর প্রেমের রসায়ন ঘটাতে পুরোপুরি সফল। তবে ছবির শুরুতে যে প্রেমের শুরু শেষে প্রেমের গভীরতা পায়নি মনে হলো। ত্যানা প্যাচানোর মতো করে গল্প বলা হয়েছে। অযৌক্তিক পরিণতি ঘটেছে।
গল্পের বুননে অপরিপক্কতা লক্ষ্যণীয়। তবে চরিত্রগুলো তাদের সেরাটা দিতে পেরেছে। ইয়াশ রোহানের প্রথম সিনেমা হিসেবে ভালো অভিনয়, মিশা সওদাগরের ভিন্ন ধারার অভিনয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা যায়। শহিদুল আলম সাচ্চু ও ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় বরাবরের মতো।
সিনেমার শুরুর নিরব দৃশ্যগুলো ভালো লেগেছে। মনোরম দৃশ্য সংযোজন করা হয়েছে। দৃষ্টি নন্দন দৃশ্যায়ন ও সিনেমাটোগ্র্রাফির ব্যবহার ছিলো চমৎকার। সম্পাদনারীতিতে মুন্সিয়ানা দেখানো গেছে। আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার ছিলো যথাযথ। তবে শব্দ সংযোজনে আরও কৌশলী হওয়া দরকার ছিলো। ফজলুর রহমান বাবুর বমি করার শব্দের যথাযথ প্রয়োগ ঘটেনি।
এবার ছবির মুল আলোচনায় আসা যাক। ছবিটির মুল গল্প বা চিত্রনাট্য রচনা ও এর ধারণা নিয়ে যদি বলতে হয়। তবে বলতে হবে চিত্রনাট্য দুর্বল। এর কারণ ব্যাখ্যা করা যাক।
ছবির শুরুতে দেখা যায় তিনজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি। আয়নাল গাজি, রহমান মিয়া ও হিরন সাহা। হিরন সাহা হিন্দু। আর সবচেয়ে প্রভাবশালী আয়নাল গাজি। আয়নাল গাজির একটি ডাকাত দল মাছ ডাকাতি করে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নৌকা থেকে। সেই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিরন সাহা এর জবাব চাইতে গেলে তাকে গুম করে ফেলে আয়নাল গাজী। এরপর হিরন সাহার বাড়ি আর মিল কারখানা আত্নসাৎ করে তার পরিবারকে ভারতে পাঠিয়ে দেয় কৌশলে। হিরন সাহার পরিবার জানতে পারে সে একটি তরুণী মেয়েকে বিয়ে করে কলকাতা চলে গেছে। সেখানে চিঠি লিখে আসতে বলে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। কিন্তু এই কারসাজি মুলত গাজীর। হিরন সাহাকে আটকে রেখে তার হাত দিয়ে চিঠি দেয় ও তার ব্যাংকের লেনদেন করে। হিরন সাহার পরিবার কলকাতা চলে গেলে দেখা যায় একটি চরের মধ্যে তাকে আটকে রেখেছে আয়নাল গাজী। এরপর তাকে হত্যা করে।
এদিকে তার পরিবার কলকাতা তার দেওয়া ঠিকানায় তার স্ত্রীর বোনের বাড়িতে যায়। সেখানে হিরনকে না পেয়ে তার স্ত্রী ও মেয়ে শুভ্রা ও ছেলে দু:চিন্তায় পড়ে। কিন্তু সেখানেই নির্মাতা একটি ক্লাইমেক্স নষ্ট করে ফেলে।
সেখানে যদি হিরনকে হত্যা করা না দেখিয়ে তার পরিবারের কলকাতা যাওয়ার মাধ্যমেই ক্লাইমেক্স ধরে রাখা যেতো। আর এদিকে তার সম্পত্তি আত্নসাত করে বাবু সব ভোগদখল করছে। পরে একটি বজরায় এ তথ্য ফাঁস করছে। এগুলো তো ছিলোই।
আয়নাল গাজি হিরন সাহার সম্পত্তি আত্নসাতের পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তিনি টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এ জন্য তিনি রহমান মিয়ার দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তার মিল বিক্রির জন্য। সেটি না পারলে মিল বা বাড়ি বন্ধক রেখে মাত্র ২ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য। কথা হচ্ছে যার জীবন যাপনে দেখা যায় কোটি টাকার সম্পদ তার। সে মাত্র ২ লাখ টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। হ্যাঁ যদি এমন হতো তার মিলে আগুন লেগে কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। আর তার স্ত্রী সব নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাহলে একটি যৌক্তিক অবস্থান তৈরি হতো।
সিনেমার প্রথমার্ধে একটি গতি ছিল। ছিলো ক্লাইমেক্স। কিন্তু সেই ক্লাইমেক্স শেষ হয়ে গেলো হঠাৎ। পরিণতি বোঝাই যাচ্ছিল। বাবু ধরা পড়লো। শুভ্রার পরিবার কলকাতা থেকে দেশে ফিরে এলো। এর আগে অবশ্য দু’বার রোহান শুভাকে আনতে গেলো।
দেশে ফিরে এলেও জাতের দোহাই দিয়ে শুভ্রা-অপুর পরিণতি পাচ্ছেনা। শুভ্রার বিয়ে ঠিক হলো। অপুকে জোর করে বাবা লঞ্চে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। লঞ্চে থেকে হঠাত অপু লাফ দিলো শুভ্রার কাছে যাওয়ার জন্য। নদীতে তার মৃত্যু হয়। শুভ্রার বিয়ে হয়ে যায়। সে একটি নদীর ধারে জানালায় দাঁড়িয়ে কাউকে খুঁজে বেড়ায়। ছবি শেষ হয়।
যদি শুভ্রাকে দেশে না ফিরিয়ে এনে কলকাতায় তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। সেখান থেকে অপুকে তার বাবা ধরে আনছে। এ সময় লঞ্চ থেকে সে লাফ দিচ্ছে। নদীতে ডুবে মরে সে। এই বিচ্ছেদের একটা যৌক্তিক কারণ থাকতো। এক্ষেত্রে গল্পটি ও তাদের প্রেমের পরিণতিতে অনুভূতি আরও তীব্র্র হতো। চাঁদপুর থেকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার সময় নদীতে লাফ দেওয়ার মধ্যে অনুভূতির যৌক্তিকতা থাকেনা।
ছবির ক্লাইমেক্স তৈরিতে কিছু ক্ষুদ্র বিষয় বাধা তৈরি করেছে। তবে অপু-শুভ্রার প্রথম বিচ্ছেদের বিরহের সংলাপগুলো হৃদয় ছুঁয়েছে। শুভ্রার অপুর প্রতি অধিকার নিয়ে বলা হৃদয় নিংরানো সংলাপ ‘তুমি আমার’-জালে বন্দি করেছে স্বপ্নজালের দর্শকদের।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা।