বিশেষ প্রতিবেদক :
নব্বই দশকের টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় মুখ, মঞ্চ ও টেলিভিশনের মেধাবী অভিনয়শিল্পী তাজিন আহমেদ। যার মোহনীয় অভিনয়শৈলী মন জুড়িয়ে যায়। গত দুই দশকে অভিনয়শিল্পী, সাংবাদিক ও উপস্থাপক হিসেবে নিজের জায়গা করে নেন তিনি। প্রিয় তাজিন আহমেদের আকস্মিক মৃত্যুতে মর্মাহত সবাই। নিজের সমসাময়িক সহকর্মী তো বটেই এ প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের কাছেও সমান প্রিয় তিনি। তিনি সবার প্রিয় তাজিন আপু।
মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে চারটায় উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে মারা গেলে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা শোকাবহ হৃদয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করতে ভুলেননি এ প্রজন্মের তাঁর সহকর্মীরা। তারা ফেসবুকে তাজিন আপুর সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতি তুলে ধরেন।
তাজিনের মৃত্যুর আগে তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলেন এ প্রজন্মের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমি হামিদ। তাজিন আহমেদের সঙ্গে নিজের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, একটু আগে যখন তোমার গালে হাত বুলাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল তুমি জেগে উঠবা বলবা সর, যাহ ঘুমাইতে দে। শুটিংয়ে তো যখন ঘুমাইতা উঠে যাইতা, এখনতো উঠোনা আপু। তোমার নরম গালে শেষ বারের মত হাত বুলালাম বিশ্বাস হচ্ছে না। এত কষ্ট মনে নিয়ে চলে যাওয়া উচিত হয় নাই তাজিন আপু। হাঁসের মাংস খাইতে পারলাম না। ভাল থাইকো যেখানেই থাকো।
অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে স্মৃতিচারণ করে বলেন, সত্যিই তাজিন আপু, ভালো লাগা মুহুর্তগুলি সবসময় স্মৃতি হয়ে যায়।
টিভি নাটকের এ সময়ের অভিনয়শিল্পী রিমি করিম তাঁর ফেসবুকে স্মৃতিচারণ করে লিখেন, আর দেখা হলো না আপু তোমার সাথে। তবে একদিন দেখা হবে ওপারে। আপু ভালো থেকো ওপারে। এভাবেই কী মানুষ চলে যায়? মানুষ চলে যায়, স্মৃতি থেকে যায়। এ সময় এ অভিনেত্রী একটি নাটকের সেটে তাজিন আপুর সঙ্গে তোলা কিছু ছবি পোস্ট করেন।
অভিনেত্রী তিতান চৌধুরী তাজিন আহমেদের ছবি ও তাঁর সাথে চ্যাটিংয়ের কিছু স্ক্রীন শর্ট দিয়ে লিখেন, ১০ ঘন্টা আগেও অনলাইন ছিলে আপু, হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো তোমার!!! তুমি কি আর কখনো কথা বলবে না?
নিজের সঙ্গে তোলা একটি ছবি পোস্ট করে এ সময়ের টিভি নাটকের অভিনয়শিল্পী অধরা প্রিয়া তাঁর স্ট্যাটাসে লেখেন, যেখানেই থাকো, ভালো থাকো আপা।
নিজের সঙ্গে স্মৃতির আলপনা আঁকি নাটকের সেটে তোলা ছবি পোস্ট করে অভিনেতা আর এ রাহুল লেখেন, বিশ্বাস হচ্ছে না অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ আপু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন! কত স্নৃতি আর কত কথা! বলে বোঝাতে পারবো না অল্প সময়ে এই বদরুল মাস্টারকে কতটা ভালোবাসা ও অভিনয় পরামর্শ তিনি দিয়েছেন!
অনেক গল্প জমা, এক সাথে মানিকগঞ্জ যাওয়া আসা, একসাথে কাজ করা, খুব কষ্ট হচ্ছে। যেখানে চলে গেলেন, ভালো থাকুন আপু। আমরা সবাই আপনার জন্য দোয়া করি। এভাবে চলে যাওয়া বিশ্বাস করাও কষ্টের।
অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া তাঁর ফেসবুক স্ট্যটাসে তাজিন আহমেদের বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করে লিখেছেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তাজিন আপার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি!
এদিকে নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, তাজিন আহমেদ আর নেই। এমন কী কথা ছিল? আমার নির্দেশিত প্রথম প্রচার হওয়া নাটকের শিল্পী ছিলেন তাজিন।
তাজিন আহমেদের কর্মজীবন ছিলো বৈচিত্র্যময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর শখের বশে অভিনয় শুরু করেন। তবে নিজেকে তৈরি করতে ভর্তি হন থিয়েটারে। মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে পুরোদমে শুরু করেন অভিনয়। তাজিন আহমেদের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী। তবে ছোটবেলায় বাবাকে হারানোয় পাবনায় নানা বাড়িতে বেড়ে ওঠেন তিনি। এরপর কৈশোরে চলে আসেন ঢাকায়। মায়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল আদাবরে।
তাজিন আহমেদের এক সময়ের সহকর্মী এটিএন বাংলার চিফ এক্সিকিউটিভ এডিটর জ. ই. মামুন ফেসবুকে লিখেছেন, তাজিন আমার এক সময়ের সহকর্মী, প্রিয় ছোট বোন। নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন ভোরের কাগজের রিপোর্টার, তাজিনরা তখন আরেক অকালপ্রয়াত বন্ধু, শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর সাথে ফিচারে কাজ করতো। তারপর এক সময় তাজিন অভিনয় শুরু করে, তারকাখ্যাতি পায়। মাঝে মাঝে দেখা হলে সেই ভোরের কাগজের আমলের মতোই মায়াবী আবদার করত, আমার চোখেও ওকে সেই কলেজ পড়ুয়া ফিচার লেখকই মনে হতো।
‘কিন্তু এমন অসময়ে সবাইকে ছেড়ে ও চলে যাবে, ভাবতেই পারছি না, মানতেও পারছি না। এটা কী হলো তাজিন?’
তাজিন আহমেদ ভোরের কাগজ, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। আনন্দ ভুবন ম্যাগাজিনের কলামিস্ট ছিলেন। পরে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালে মায়ের রচনা ও শেখ নিয়ামত আলীর নির্দেশনায় ‘শেষ দেখা শেষ নয়’ এর মাধ্যমে টেলিভিশন অভিনয়ে তার যাত্রা শুরু। ‘নাট্যজন’ নাট্যদলের মাধ্যমে মঞ্চে কাজের শুরু। এরপর ‘আরণ্যক’ নাট্যদলে যোগ দিয়ে শেষ অবধি ছিলেন। টিভি নাটক ছাড়াও রেডিও এবং টেলিভিশনে উপস্থাপনা করেন তিনি।
বুধবার দুপুরে বাদ যোহর বনানী গোরস্থানে বাবার কবরেই শায়িত হবেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। ততক্ষণ উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের সামনে ফ্রিজিং করা গাড়িতেই রাখা হয়েছে তার মরদেহ।
এদিকে মৃত্যুর আগে তাজিন আহমেদের ফেসবুকে শেষ স্ট্যাটাস সবার মন কেড়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ভালো লাগা মুহুর্তগুলো সবসময় স্মৃতি হয়ে যায়। এ সময় তিনি বেশ কিছু ছবিও আপ করেছিলেন। এর আগে কিছু মর্মস্পর্শী বাণীসংবলিত স্ট্যাটাসও তিনি দেন।
কালচারাল ইয়ার্ডের পক্ষ থেকে এই গুণী অভিনেত্রীর জন্য শ্রদ্ধা।