অঞ্জন কাঞ্জিলাল, প্রখ্যাত বাঙালি নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। নাটকের পাশাপাশি বেশকিছু তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেছেন। সম্প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। আগামী বছর চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু করবেন। দিল্লির ‘গ্রিনরুম’ থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। দিল্লিতে অল্পসংখ্যক বাঙালি থাকলেও সেখানে বাংলা নাটক টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। থিয়েটার চর্চার শুরু ছোটবেলায়। কলকাতার গোবরডাঙ্গায় নাটকের দল ‘গোবরডাঙ্গার নক্সা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকের ওপর মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
সম্প্রতি নাটকের দল ‘প্রাঙ্গণেমোর’ আয়োজিত এক নাট্য কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে এসেছিলেন বাংলাদেশে। গত ৬-৮ সেপ্টেম্বর তিনদিনব্যাপী কর্মশালাটি পরিচালনা করেন তিনি। শিল্পকলা একাডেমির চিলেকোঠায় বসে নাটক ও নিজের জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করেন কালচারাল ইয়ার্ড-এর সঙ্গে। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক ঝুমুর আসমা জুঁই। আজ থাকছে সাক্ষাৎকারটির শেষ অংশ।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনাদের ‘গ্রিনরুম’সম্পর্কে কিছু বলেন?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: ‘গ্রিনরুম’এ আমাদের ৪৪ জনের মতো সদস্য। যেটা অবাঙালি জায়গায় বেশ গর্বের বিষয়। আমরা আন্তর্জাতিক নাট্যৎসব করেছি, আবার করবো। বিভিন্ন সেমিনার করা হয়। ওয়ার্কশপ করা হয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আমরা নিয়মিত নাট্যচর্চার মধ্যে রয়েছি। যাদের নিয়ে কাজ করছি তাদের অনেকেই থিয়েটারের মানুষ নয়। কিন্তু ‘গ্রিনরুম’-এ এসেই তাদের থিয়েটারের শিক্ষা। আজকে তারা দেশে বিদেশে শো করছে। অনেকে সিনেমায় কাজ করছে। আমার দল থেকে বেশ তিন চারটি ছেলেমেয়ে সিনেমায় নিয়মিত কাজ করছে। তারা আমার হাতেই তৈরি। মানে ‘গ্রিনরুম’ থেকে তাদের প্রোডাকশন করা। ছোট হলেও এটা গর্বের বিষয়।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদের দেশে থিয়েটার থেকে যারা মূলত ভিজুয়াল মিডিয়ায় কাজ শুরু করে, তারা একসময় দেখা যায় থিয়েটারে সময় দিতে পারে না। বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: না। সত্যি কথা বলতে এখনও এই জায়গাটা পুরোপুরি তৈরি হয়নি যে, থিয়েটার করে খুব সুস্থ জীবিকা, স্বাভাবিক জীবিকা বা জীবন যাপন করতে পারে বা প্রাচুর্য্যের মধ্যে থাকতে পারে। সে জায়গাটা এখনও থিয়েটার আমাদের দিতে পারেনি। সেক্ষেত্রে থিয়েটারের সময়টুকু বাঁচিয়ে সে যদি দুরদর্শনে বা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারে বা ভয়েজ ওভার করে পয়সা রোজগার করতে পারে, এটা ভালো লক্ষণ। কারণ সেতো অভিনয়ের মধ্যেই রয়েছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: প্রফেশনাল থিয়েটার বলতে একটা বিষয় আছে। যেটা আমাদের এখানে নেই। ভারতে আছে কিনা?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: প্রফেশনাল থিয়েটার একসময় ভারতে সাংঘাতিক ভাবে ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে ছিলো। আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে এই প্রফেশনাল থিয়েটার বন্ধ হতে শুরু করে। এখন খুবই গুটিকয় নামমাত্র জায়গায় ওটা টিকে আছে। আর প্রফেশনালিজম ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, এটা মানে যদি পয়সা নিয়ে থিয়েটার করা হয় সেটার একটা মানে। প্রফেশনালিজম বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা কিন্তু অনেকগুলো দলই প্রফেশনাল লেভেলে কাজ করছে। অনেক শিল্পী কলকাতায় প্রফেশনালি কাজ করছে। সেদিক থেকে তাদেরকে আমি প্রফেশনাল বলে ধরে নিতেই পারি। একটা কোম্পানি থিয়েটারের স্ট্রাকচার তৈরি হয়েছে কলকাতায়। সেভাবেই কাজ হচ্ছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: এর ধরণটা আসলে কেমন?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: থিয়েটারের ভাষাতো আট দশ বছর বাদে বাদে পাল্টে যায়। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারের ভাষা পাল্টাতে থাকে ।কারণ থিয়েটার তো আসলে সমাজের কথা বলে, জীবনের কথা বলে, মানুষের কথা বলে। কখনো স্তানিস্লাভস্কি ফর্ম নিয়ে কেউ কাজ করছে, কেউ ব্রেক নিয়ে কাজ করছে, কেউ মায়াকোভস্কি নিয়ে কাজ করছে। কেউ পুরনো ফর্ম নিয়ে কাজ করছে । যে যেমন ভাবে পারছে তার ভালোবাসার মানুষ, ভালোবাসার পরিবার, ভালোবাসার থিয়েটার নিয়ে তার মতো করে সাজাতে চায়। এর মধ্যে কোন খারাপ দেখিনা।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনি ভিজুয়াল মিডিয়ায়ও কাজ করেছেন অনেক। সে সম্পর্কে যদি বলেন-
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: একটা সময় নিয়মিত টিভিতে কাজ করেছি। তখন DD1, DD7 ছিলো। এতো চ্যানেল এর দৌরাত্ন হয়নি। দিল্লি যাওয়ার পর কিছু অ্যাড যেমন, আইপিএল এর অ্যাড ফিল্মে কিছু কাজ করেছি। এনডিটিভির সঙ্গে কিছু কাজ করেছি। বাকি অনেক থিয়েটার নিয়ে করেছি। তবে শীঘ্রই একটা চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হচ্ছে আমার পরিচালনায়। সেটা আগামী বছরের শুরুতে শুরু করার ইচ্ছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনার ছেলে চলচ্চিত্রে কাজ করছে। তিনি থিয়েটারের সঙ্গে আছেন কিনা এখনও?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: হ্যাঁ । মানে ও সময়টা এখন কম দিতে পারছে। কিন্তু ও তো থিয়েটারেরই প্রোডাক্ট। জন্ম থেকেই থিয়েটার করছে। ওর ১৩ বছর বয়সে দেওয়া নামেই নামকরণ হয় ‘গ্রিনরুম’ থিয়েটার। সেই অর্থে পুরোপুরি ও থিয়েটার মনস্ক। কিন্তু চলচ্চিত্রের কারণে ও এখন একটু কম সময় দিতে পারছে। কিন্তু যখনই সময় পাচ্ছে তখনই থিয়েটারে কাজ করছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনি কি মনে করেন চলচ্চিত্রে কাজ আর আর্ট থিয়েটার এক সঙ্গে করা সম্ভব না?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: কেন সম্ভব না। আমি বিশ্বাস করিনা। হয়তো সময়টা কমে যায়। কিন্তু যদি ব্যালেন্স করা যায়, যেমন একজন নারী তার বাবা মা, শ্বশুর শ্বাশুড়ী, সংসার দেখভাল করে অফিসে চাকরী করছে। যদি ওসব জায়গা মেইনটেইন করা সম্ভব হয়। তাহলে কেন চলচ্চিত্র আর থিয়েটার একসাথে যেতে পারেনা? এটা হচ্ছে টাইম ম্যানেজমেন্ট। প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হয়। এরপরে আস্তে আস্তে হয়। এটা নির্ভর করছে তুমি কতটা নেসেসিটি। কতটা অপ্রয়োজনীয় নও এর উপরে ডিপেন্ড করবে। সেভাবে লোকে তোমাকে টাইম ম্যানেজমেন্টে হেল্প করবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আপনার সহধর্মিনী সুমনা কাঞ্জিলাল নিয়ে যদি কিছু বলেন-
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: সুমনা বিয়ের আগে আমার ছাত্রী ছিলো। এরপর আমার সঙ্গে থেকে থেকে ওর থিয়েটারে মনস্কতা হয়েছে। থিয়েটারের কারণে আমাকে যে পারিবারিক স্ট্রাগল করতে হয় আমার সঙ্গে সঙ্গে ওকেও এটা করতে হয়। ওর লেখার হাতটি স্বচ্ছন্দ। জিআরটিতে ওর লেখা ৪-৫ টি নাটক করেছি আমরা। ও আসলে থিয়েটারের সঙ্গেই রয়েছে।
কালচারাল ইয়ার্ড: থিয়েটারের ভবিষ্যত কেমন? যেভাবে আগে থিয়েটার মানুষ করতো মন থেকে ভালেবেসে। এখন মূলত ভিজুয়াল মিডিয়ায় কাজ করার জন্যই থিয়েটার করে মিডিয়ায় জায়গা করে নিতে চায়। কি মনে করেন?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: ভবিষ্যত বলার আমরা কে। ভবিষ্যতই ঠিক করবে ভবিষ্যত কি হবে। শুধু আমি একটা জিনিষ বিশ্বাস করি যে যারা চাটুকারীতা করে থিয়েটারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তাদের একদিন সূর্য্য অস্ত যাবে। যারা প্রকৃত ভালোবেসে থিয়েটার করছে তারা একদিন এর পতাকাকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমরা যাকে আকাশ সংস্কৃতি বলছি। এখন যে ডিজিটাল মাধ্যম যেমন চলচ্চিত্র, টিভি, মোবাইলের মাধ্যমে হাতে হাতে চলে এসেছে। এর কারণে কি থিয়েটারের দর্শক খরা ঘটবে কিংবা কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: এটাই তো স্ট্রাগল। থিয়েটারের সে লড়াইতো এখনও চলছে। এখন একটা মানুষ ঘরে বসে টিভি খুলে ৫০০টা চ্যানেল দেখতে পারছে। সে কেন দশ মাইল দুরে গিয়ে থিয়েটার দেখবে। আমরা মুঠেফোনে সারা পৃথিবীকে এনে ফেলেছি। এটাই তো লড়াই। দেখুন থিয়েটার কিন্তু টিকে আছে। একটা শো যখন হাউজফুল হচ্ছে। এর মানে হচ্ছে কোথাও এর একটা স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে। স্বতন্ত্র্য একটা স্বীকৃতি রয়েছে। যেটার জন্য এটা টিকে রয়েছে। এবং আমি বিশ্বাস করি এটা টিকে থাকবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অঞ্জন কাঞ্জিলাল: এ ধন্যবাদ আমি প্রাণভরে নিলাম। ধন্যবাদ আপনাদেরকেও।
সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ: ‘থিয়েটারের জন্য চাঁদে অবধি যেতে রাজি আছি’