![ভালো কাজ করলে দর্শক তা দেখবেই: নুনা আফরোজ](https://culturalyard.com/wp-content/uploads/2018/11/Nuna-Afroz.jpg)
প্রাঙ্গণেমোর থিয়েটারের রবীন্দ্র নাট্য আয়োজন ‘রবীন্দ্রনাথে পাঁচদিন প্রাঙ্গণেমোর’ চলছে রাজধানীর বেইলি রোডস্থ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এ আয়োজন চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত। এ আয়োজনে পাঁচটি নাটক প্রদর্শন করা হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন ঘোষের নাট্যরূপ ও অনন্ত হীরার নির্দেশনায় নাটক ‘শ্যামাপ্রেম’, নুনা আফরোজের নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি নাটক ‘স্বদেশী’, ‘রক্তকরবী’ ও ‘শেষের কবিতা’। এছাড়াও নুনা আফরোজের লেখা ও নির্দেশনায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। এ আয়োজন নিয়ে কালচারাল ইয়ার্ডের সঙ্গে আলাপ হয় প্রাঙ্গণেমোর’র অন্যতম কর্ণধার নুনা আফরোজের। তাঁর সাক্ষাতকার নিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক ঝুমুর আসমা জুঁই।
কালচারাল ইয়ার্ড: ‘রবীন্দ্রনাথে পাঁচদিন প্রাঙ্গণেমোর’- এ আয়োজনের প্রেক্ষাপট নিয়ে জানতে চাই।
নুনা আফরোজ: প্রাঙ্গণেমোর অতীতে অনেক বড় বড় নাট্যৎসব করেছে ১০-১২ দিনব্যাপী। নিজেদের নাটক নিয়ে ঘুরেছে। দুই বাংলার রবীন্দ্র নাট্যমেলা করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের ৭টি নাটক নিয়ে উৎসব করেছে। ১০ বছর পূর্তিতে নিজেদের ১০টি নাটক নিয়ে নাট্যমেলা করেছে। ইভেন চট্টগ্রামে গিয়েও ‘কর্ণফুলী প্রাঙ্গণেমোর উৎসব’ করেছে। কলকাতায় নিজেদের নাট্যোৎসব করেছে। এরকম নানা ধরণের বৈশিষ্ট্য আমাদের রয়েছে। এবারের আয়োজন ‘রবীন্দ্রনাথে পাঁচদিন প্রাঙ্গণেমোর’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পাঁচটি নাটক প্রাঙ্গণেমোর করছে।
আমরা হঠাৎ খেয়াল করলাম, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের পাঁচটি নাটক আছে। তাহলে কেন আমরা সেই পাঁচটি নাটক একত্রে করবো না। এটা মনে হয় একটি ইতিহাস, যে কোন দলের মনে হয় এরকম কোন পাঁচটি নাটক নেই রবীন্দ্রনাথের। কোন দল এরকম করেছে, সেটাও মনে হয় নেই। আমার দল এটা অনুধাবন করেছে যে, আমাদের পাঁচটি নাটকের মধ্যে চারটি নাটকই আমার নির্দেশনায়। এর মধ্যে তিনটি রবীন্দ্রনাথের নাটক। একটি চার অধ্যায় উপন্যাস অবলম্বনে ‘স্বদেশী’, আরেকটি হচ্ছে নাটক ‘রক্তকরবী’, অন্যটি উপন্যাস শেষের কবিতার নাট্যরুপ ‘শেষের কবিতা’। আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমি একটি নাটক লিখেছি। সেটি হচ্ছে ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’। পাঁচটি নাটকের মধ্যে চারটি নাটকরই নির্দেশক আমি। এর মধ্যে একটি নাটক আমার নিজের লেখা ও নির্দেশনা। তবে এই পাঁচটি নাটকেরই মূল চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি। এই ঘটনাটা বোধহয় শুধু বাংলাদেশেই না দুই বাংলা মিলিয়ে এই প্রথম। আমার দল প্রাঙ্গণেমোর এই সবকিছু মিলিয়েই সেলিব্রেট করতে চেয়েছে। তাই এ আয়োজন।
আরেকটি কারণ হচ্ছে আমরা মহিলা সমিতিতে এই আয়োজনটি করেছি। মহিলা সমিতি অনেক বছর বন্ধ থাকার পর যখন চালু হলো কিন্তু সেইভাবে নিয়মিত নাটক হচ্ছেনা। মাসে ৫টি কি ৬টি। কোন মাসে ১টি বা ২টি। মহিলা সমিতিতে আমরা সেভাবে নাটক করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিনা। দর্শকও মনে হয় যেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে না। সবকিছু তো ধীরে ধীরে জমে উঠে। সেখানেও আমাদের একটি ভাবনা কাজ করেছে যে আমরা এটি মহিলা সমিতিতে করি। উৎসবকে কেন্দ্র করে তো আসলে অনেক লোকের সমাগম হয়। প্রচারণাটা হয়। আর তাই এর মধ্য দিয়ে দর্শকও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে মহিলা সমিতির সাথে। এ আয়োজনটার পেছনে আসলে এরকম অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
![আমি ও রবীন্দ্রনাথ](http://i1.wp.com/culturalyard.com/wp-content/uploads/2018/11/Ami-o-Rabindranath.jpg)
আমি ও রবীন্দ্রনাথ
কালচারাল ইয়ার্ড: উৎসবের এই নাটকগুলো কী এটাই প্রথম প্রযোজনা?
নুনা আফরোজ: না। ‘শ্যামাপ্রেম’ চিত্তরঞ্জন ঘোষের নাট্যরুপ ও অনন্ত হীরার নির্দেশনায় প্রথম প্রদর্শন হয় ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে চার অধ্যায় উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘স্বদেশী’ নাটক ও ‘রক্তবরবী’ নাটক ২০০৮-এ । ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’- ২০১৩ সালে প্রথম প্রদর্শনী হয়। এগুলো বিভিন্ন সময় অনেক শো হয়েছে। কিন্তু চার অধ্যায় উপন্যাস অবলম্বনে করা ‘স্বদেশী’ নাটকটি দীর্ঘদিন শো হয়নি। অনেকদিন পর এই নাটকটি মঞ্চে আসছে। আসলে একটি নাটকের অনেক মঞ্চায়ণ করবো এভাবে আমরা কখনো ভাবিনা। আসলে আমাদের দর্শক কত। থিয়েটারই শুধু না যে কোন মাধ্যমেরই দর্শক সংখ্যা কম। আসলে ঘুরে-ফিরে একই দর্শক। এ জন্য নাটকের মঞ্চায়নের সংখ্যাটা না বাড়িয়ে নাটকের সংখ্যাটা বাড়ানো আমরা উচিত মনে করি।
কালচারাল ইয়ার্ড: আমরা দেখেছি প্রাঙ্গণেমোর সবসময় দর্শকদের জন্য নতুন কিছু করে। তো এবারের আয়োজনের উদ্দেশ্যটা কি?
নুনা আফরোজ: এর উদ্দেশ্যগুলো আগে আমি বলে গেছি। তবে এবারের আয়োজনে দর্শকদের কাছে নতুন হচ্ছে একই সঙ্গে পাঁচটি রবীন্দ্রনাথের নাটক। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক। একসাথে এতগুলো রবীন্দ্রনাথের নাটক দর্শক দেখতে পাবে। এটি তাদের জন্য একটি আকর্ষণ। আর এখন যেহেতু অনেক দর্শক বেড়েছে। আমরা অনেক নতুন দর্শক তৈরি করতে পেরেছি। তাই দর্শক এর অনেক নাটকগুলোই আগে দেখেনি। তারা এ আয়োজনের মাধ্যমে এ নাটকগুলো দেখতে পাবে। ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘রক্তকরবী’ যদিও অনেক হচ্ছে। তবে বাকিগুলো দর্শক নতুন করে অনেক দিন পর দেখতে পাবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: রক্তকরবী নিয়ে যদি কিছু বলেন-
নুনা আফরোজ: আসলে রক্তকরবী একটা ব্রান্ড নাম। এটা অনেক কঠিন নাটক তো বটেই। সব চরিত্রগুলোই চ্যলেঞ্জিং। আর আমি যে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করি। এটাতো অবশ্যই একটি চ্যলেঞ্জিং ক্যারেক্টার। আর অনেকেই বলে রবীন্দ্রনাথের নাটক এখন করে লাভ কি। এই কথাটি আমার কাছে খুবই হাস্যকর মনে হয়। একটু গভীরে গেলে দেখতে পাবো রবীন্দ্রনাথের নাটক আজ থেকে ২০ বছর পরে গেলেও সময়পোযোগী। অর্থাৎ এটি সর্বকালীন ও সর্বজনীন। যে কোন সময়ে এর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো একই সাথে সর্বকালীন ও সর্বজনীন।
কালচারাল ইয়ার্ড: প্রাঙ্গনেমোরের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এরকম আয়োজনের কোন ভবিষ্যত পরিকল্পনা আছে কী?
নুনা আফরোজ: প্রাঙ্গণেমোর ভবিষ্যতে নতুন কিছুই দর্শকদের উপহার দেবে এটা আমার বিশ্বাস। কারণ এ পর্যন্ত প্রাঙ্গণেমোর যা করে আসছে তা দর্শকদের ভালো লাগবে এ বিবেচনা মাথায় রেখেই করে যাচ্ছে, যাবে। রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে প্রাঙ্গণেমোরের আরও নতুন নতুন পরিকল্পনা আছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আরও নতুন নতুন কাজ দেখা যাবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: নতুন নাট্যকর্মীদের নিয়ে যদি কিছু বলেন।
নুনা আফরোজ: আসলে যারা নাট্যকর্মী। নতুন পুরনো যাই হোক আমরা সবাই নাট্যকর্মী। থিয়েটার বা অন্য যে কোন মাধ্যমেই তারা থাকুক না কেন। সেই কাজটি সম্পর্কে সৎ থাকা ও শিক্ষিত হওয়াটা খুব জরুরী। আসলে নির্দেশনা বা অভিনয় যাই কিছু করিনা কেন তা করতে হলে অবশ্যই বেশি বেশি নাটক দেখতে হবে। নাট্যকর্মী ও বাইরের লোকদের সবারই বেশি বেশি নাটক দেখা উচিত। আর আদর্শ নাটকর্মী হতে গেলেতো নাটক দেখতেই হবে।
কালচারাল ইয়ার্ড: একই সঙ্গে আপনি যখন নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পী। ব্যাপারটাকে কীভাবে ম্যানেজ করেন?
নুনা আফরোজ: আসলে দুটো তো আলাদা দুটি সত্ত্বা। তবে দুটি একসাথে করতে গেলে কখনো অভিনেত্রী নির্দেশককে ডমিনেট করে। আবার কখনো নির্দেশক অভিনেত্রীকে ডমিনেট করে। যখন নাটক তৈরী হতে থাকে। তখন নির্দেশক ডমিনেট করে অভিনেত্রীকে। নাটকটি যখন তৈরী হয়ে যায় তখন আমি মাথায় রাখিনা আমি নির্দেশক। তখন সেলফিস হয়ে যাই আমার অভিনয়ের ক্ষেত্রে। অনেক নির্দেশক যখন নাটকটি মঞ্চে যায় তখন তাদের টেনশন শুরু হয়ে যায়। তবে আমি যখন মঞ্চে নাটকটি চলে যায় তখন কোন টেনশন নেইনা। আমার মনোযোগ থাকে শুধুমাত্র অভিনয়ের দিকে। তখন আমি শুধুই অভিনেত্রী। নাটক শুরু হয়ে গেলে আমি আর অন্যের অভিনয় দেখিনা। আমি জানি গুলি ছোঁড়া হয়ে গেছে। কে কি ভুলভাল করলো। সেটি দেখতে আমি রাজি নই। কারণ সেটি দেখতে দেখতে আমার অভিনয় আমি নষ্ট করতে চাইনা। এখানে আমার নির্দেশক সত্ত্বা আলাদা। আমার অভিনয়ের সত্ত্বা আলাদা।
কালচারাল ইয়ার্ড: পাঁচটি নাটকের মধ্যে চারটি নাটকের নিদের্শকই আপনি। কেমন লাগছে বিষয়টি?
নুনা আফরোজ: হ্যাঁ। এটা অবশ্যই ভালো লাগার একটি ব্যপার। চারটি নাটকই আমার নির্দেশনা। এবং এই ঘটনা দুই বাংলা মিলিয়ে এই প্রথম। অবশ্যই ভালো একটি অনুভূতি।
কালচারাল ইয়ার্ড: নাট্যকার না হলে কি হতেন?
নুনা আফরোজ: ভাববার সুযোগ পাইনি। তবে ছোটবেলায় মা চাইতেন আমি ডাক্তারি পড়ি, আর বাবা চাইতেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। তবে আমার বাবা সংস্কৃতিমনা ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আমি থিয়েটার করতাম। আমি ৩৩ বছর ধরে থিয়েটার করি। আমি বা আমরা প্রাঙ্গণেমোর যত বাধা এসেছে আমরা তত এগিয়ে গেছি। তো এক্ষেত্রে আমি কখনো ভাবিনি থিয়েটারকর্মী না হলে আমি কি হতাম। সেটি ভাবার সুযোগই হয়নি কখনো। আমি থিয়েটারই করে গেছি সবসময়। তবে হ্যাঁ, আমি যদি থিয়েটার না করতাম তাহলে হয়তো আরও বেশি আয়েশী জীবন কাটাতে পারতাম। আরও বিলাসী জীবন যাপন করতে পারতাম। তবে সেই বিলাসী জীবন বোধহয় আমাকে ভালো লাগাবে না। বরং থিয়েটারটাই করতে চাই।
এখনও সমান আগ্রহে সমান সিনসিয়ারিটি নিয়ে থিয়েটারটা আমি করি। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত যেন আমি থিয়েটার করে যাই। এমন যেন না হয় যে আমি বেঁচে আছি, কিন্তু থিয়েটারের মঞ্চে আমি দাঁড়াতে পারছি না। এমনটা যেন না হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি থিয়েটার করে যেতে চাই। এমন অনেকেই আছে যে শুরুতে যে কোন কাজের আগ্রহ আছে তাদের। তবে আস্তে আস্তে সেই আগ্রহটা মিইয়ে যায়। কিন্তু আমি সমান আগ্রহে সমান সিনসিয়ারিটি নিয়ে থিয়েটার করে যাচ্ছি। এই আগ্রহটা ধরে রেখে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি থিয়েটার করে যাবো। আশা করি আমি পারবো।
কালচারাল ইয়ার্ড: তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাংলা নাটকের ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?
নুনা আফরোজ: আসলে এই কঠিন সময় দাঁড়িয়ে সবাই বলছে থিয়েটারে দর্শক নেই। আসলে সিনেমা হলেও কি দর্শক আছে। একটু সার্ভে করে দেখেন তো কয়জন দর্শক যাচ্ছে। কিংবা কয়টি চিত্র প্রদর্শনী বা সঙ্গীতানুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে সবাই যাচ্ছে। আসলে এগুলো কমে যাচ্ছে। আবার ভালো কাজেরও দর্শক পাওয়া যায়। উপচে পড়ছে এমন তো পাওয়া যায়। আসলে ভালো কাজের বিকল্প নেই। ভালো কাজ করলে তথ্য প্রযুক্তি যাই বলেন, কিছু দমিয়ে রাখতে পারবেনা। ভালো কাজ করলে দর্শক তা অবশ্যই দেখবে।