বিশেষ প্রতিবেদক:
মঞ্চ ও টেলিভিশন কিংবা চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাথমিক গাঁথুনি হচ্ছে চিত্রনাট্য। একটি নাটক বা চলচ্চিত্র তৈরি করার যে ভিত্তি তা গড়ে ওঠে চিত্রনাট্যের উপরে। তবে সেই চিত্রনাট্য মূখ্য হয়ে উঠছেনা। মূখ্য হয়ে উঠছে এর উপস্থাপনভঙ্গিই। অর্থাৎ একটি নাটক বা চলচ্চিত্রটাই সেখানে মুখ্য হয়ে উঠে। একটি ভালো চলচ্চিত্র বা নাটক মানেই হচ্ছে এর একটি গোছালো চিত্রনাট্য আছে বিষয়টি তেমন নয়। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত নাটক বা চলচ্চিত্র রয়েছে সেখানে কোন লিখিত চিত্রনাট্য নেই। আর চিত্রনাট্যকারকে খুব ফোকাস করে দেখানো হবে এমনও কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। চূড়ান্ত নাট্যরুপটাই সেখানে মূখ্য। তবে ভালো নাটক বা চলচ্চিত্র হলে সেটি অবধারিতভাবে সবকিছুকে সামনে নিয়ে আসবে।
বাংলা একাডেমিতে তিনদিনব্যাপী আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের দ্বিতীয় দিন সকালে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চিত্রনাট্য বিষয়ে একটি আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা এ সব বিষয়ে আলাপ করেন। বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন নাট্যকার মাহবুব আজিজ, আলতাফ শাহনেওয়াজ, সায়মন জাকারিয়া ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী।
আলোচনায় আলতাফ শাহনেওয়াজ বলেন, একটি নাটক বা চলচ্চিত্র সামগ্রিকভাবে নির্মাণ হয়। অর্থাৎ একা একা কোন চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করা যায়না। একজন চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক সম্মিলিতভাবে চিত্রনাট্য তৈরী করে সে অনুযায়ী প্রডাকশন ডিজাইন করেন। সেই ভিত্তির উপর তৈরী হয় নাটক বা চলচ্চিত্র। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে একজন নাট্যকার মনে করেন আমি নাটক লিখেছি। এর থেকে একটি লাইনও সরানো যাবেনা। আর একজন পরিচালক মনে করেন আমি তো গড। অর্থাৎ তিনি তার কেরামতি প্রকাশ করতে নাটকের উপরে চেপে বসে। ডিজাইনের দিক দিয়ে সেই নাট্যরুপে সে একটা ধোঁয়া তৈরি করে দিচ্ছে। একটি গিমিক তৈরি করা। এটি হয়ে আসছে। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যকারের একটি মূল্য আছে। মূল্য আছে ডিরেক্টর। তাদের মধ্যে সমন্বয় দরকার। এটি একটি সমন্বিত মাধ্যম। নাটক বা চলচ্চিত্র যাই হোক সমন্বিতভাবেই কা্জ করতে হবে। তিনি মনে করেন বর্তমান নাটক ও চলচ্চিত্রগুলো মন ধাঁধিয়ে দিচ্ছেনা। তবে ডিরেক্টররা মুন্সীয়ানা দেখাতে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার একটা প্রবনতা তৈরি হচ্ছে। চিত্রনাট্য ও ডিরেকশনের সমন্বয়ই প্রয়োজন।
বন্যা মির্জা তার সঙ্গে যুক্ত করেন, অনেক সময় খুঁজে বের করতে হয় নাটকটি লিখেছেন কে? এরকম নাট্যকারদের নামও খুঁজে পাওয়া যায়না। নাট্যকার সায়মন জাকারিয়াও বলেন, একজন ডিরেক্টর যখন আমার লেখা নাটক নিয়ে কাজ করেন। তখন সে তার উপস্থাপনরীতি দিয়ে তা প্রদর্শণ করেন। সেক্ষেত্রে তার মতো করে তা উপস্থাপন করেন তিনি। সেক্ষেত্রে নাট্যকারের কোন নাম থাকেনা। রবীন্দ্রনাথের নাটক করলে যেমন এটি রবীন্দ্রনাথকে মেনশন করা হয়। সেরকম অন্যান্য নাট্যকারদের করা হচ্ছেনা। একটি নাটক ও চলচ্চিত্রে নাট্যকার বা চিত্রনাট্যকার অন্যান্য সবার মতই গুরত্বপূর্ণ। যেমন একজন সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর কিংবা লাইট ডিজাইনার বা সাউন্ড ডিজাইনার। একটি সমন্বিত প্রয়াসেই একটি প্রডাকশন হয়ে উঠে।
নাট্যকার মাহবুব আজিজ বলেন, চিত্রনাট্যের সাহিত্যমূল্য আছে কি না। এটা বলতে গেলে বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের নাট্যরুপ দিয়ে সব করা যায়। সেটি দিয়ে কবিতাও হয়, হয় গানও। যেমন অমিতাভ রেজার সিনেমা আয়নাবাজি কেন আমাদের টানছে। এর একটি কারণ এর চিত্রনাট্যের শক্তি। তিনি এ সময় সেলিম আল দ্বীনের অতীত চিত্রনাট্য তৈরি রীতি ও এর আখ্যান তৈরীর কথা বলেন। চিত্রনাট্য সাহিত্যের মূল্য ধরে রাখেনা। তবে এর নিজস্ব একটি সাহিত্যমূল্য রয়েছে। তবে শুধুমাত্র চিত্রনাট্য ও সংলাপে সাহিত্যমান থাকেনা। এর জন্য চিত্রনাট্যে গান লাগবে, সিনেমাটোগ্রাফি লাগবে, এডিটিং লাগবে, অভিনয় লাগবে। এটা খারাপ কিছুনা। এটা লাগবেই।
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী মনে করেন, সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালীর কোন চিত্রনাট্য ছিলনা। জাস্ট একটা স্ক্রেচ করা হয়েছে। পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক সিনেমারই কোনো চিত্রনাট্য নাই। একেক চলচ্চিত্র নির্মাতা একেকভাবে চিন্তা করেন। একেক মানুষ একেকভাবে চিত্রনাট্য লেখেন। যেমন মেঘে ঢাকা তারার চিত্রনাট্য পড়লে আপনার ভাল লাগবেনা। পুঁজির সাথে খুব জরুরীভাবে মিশে আছে সিনেমা। সেখানে শুধু চিত্রনাট্যকার হিসেবে আমাদের সমাজে তেমনভাবে স্বাধীনভাবে কাউকে পাওয়া যায়না। যেভাবে পাওয়া যায় সিনেমাটোগ্রাফার, এডিটর। কারণ এখন দেখবেন সবচেয়ে বেশি সিনেমাটোগ্রাফার। কারণ এর এখন আর্থিকভাবে সলভেন্সি বেশি। এখন এর সাহিত্যমানের চেয়ে এর শিল্পগুন আছে কিনা। এটাই এখন বড়। সিনেমা এখন টেকনোলজির ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে এগিয়ে গেছে। টেলিভিশন আসার পর থেকে মনে করা হয়েছে সিনেমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে সিনেমা এগিয়ে গেছে টেকনোলজির সাথে। এখন বড় ব্যপার হচ্ছে আমি আমার গল্পটা বলতে চাই। আমার গল্পটা বলতে হবে। সেটা যেই মাধ্যমেই হোক। সেখানে একজন চিত্রনাট্যকারের সাথে পরিচালকের সমন্বয়টা জরুরী। দু’জনের সমন্বয়েই তৈরি হবে ভালো কোন সিনেমা।
চলচ্চিত্রে সাহিত্য মান বা সাহিত্যের এডাপ্টেশন নিয়ে নির্মাতা অমিতাভ রেজা বলেন, সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র এডাপ্ট করে বলতে সাহিত্যের সেই বইটি সামনে নিয়ে সেটি শ্যুট করা নয়। একজন চলচ্চিত্রকার সেখান থেকে জাস্ট আইডিয়া জেনারেট করে। নিজের মত করে তা নির্মাণ করেন।
চলচ্চিত্র বা নাটকে একটি নাট্যরুপ বা চিত্রনাট্য গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেই উপস্থাপনরীতিটাই মূখ্য। চিত্রনাট্য সেখানে একা একা কোন অবস্থান করে নিতে পারেনা। এর আলাদা কোন সাহিত্য মূল্যও দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে চলচ্চিত্র বা নাটকের অবশ্যই সাহিত্যমূল্য আছে। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনেক অনেক বড় বড় সাহিত্য থেকে তৈরি হয়েছে সাহিতভিত্তিক সিনেমা বা নাটক।