শাহেদ নুর:
আশির দশকে যারা বাংলাদেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে ভারতের পুনের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে পড়তে গেছেন, তাদের মধ্যে চলচ্চিত্রকার সাইদুল আনাম টুটুল অন্যতম। চলচ্চিত্র সম্পাদনায় পড়াশুনা করে দেশে ফিরে এসে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন। সম্পাদনা করেন সূর্য দীঘল বাড়ী, ঘুড্ডি, দহন, দীপু নাম্বার টু’র মতো কালজয়ী সিনেমার। সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন ‘আধিয়ার’। সম্প্রতি সরকারি অনুদানে কাজ শুরু করেছেন ‘কালবেলা’ চলচ্চিত্রটিতে। যার কিছু কাজ এখনও বাকি। এর মধ্যেই এই গুনী চলচ্চিত্রকার পাড়ি জমালেন পরপারে। তাঁর মৃত্যুতে শোকের সাগরে ভাসছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন। চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে কাজ করা বন্ধু-সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রী-গুণগ্রাহীরা অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করছেন তাঁকে। স্মৃতি হাতড়ে বলছেন নানান কথা।
ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে এই বরেণ্য চলচ্চিত্রকার মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবরে দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী, বন্ধু ও ছাত্র-ছাত্রীরা মুষড়ে পড়েন। অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় টুটুল ভাই, প্রিয় টুটুল স্যার কিংবা প্রিয় টুটুলকে স্মরণ করেন।
তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে শেয়ার করেন অশ্রুসিক্ত অনুভূতি। তিনি লিখেন, ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ প্রয়াত হয়েছেন। আমরা তাঁর প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করছি।
নির্মাতা শামীম আখতার সাইদুল আনাম টুটুল স্মরণে বলেন, সিনেমা করা মানে একই দল হয়ে যাওয়া। যতটা না পরিবার, একই ক্ষেত্রে কাজের সুবাদে তারাই বন্ধু, তারাই আপনজন। প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরা যারা স্বাধীন নির্মাতা বলে দাবি করে থাকি, তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। সুতরাং চোখে চোখ রেখে কথা হয়। আরো বেশি কথা হয় তাদের সঙ্গে, রাজনৈতিক আদর্শ বিভাজিত দেশে যাদের সঙ্গে অকপটে মন খুলে কথা বলা যায়। তারা দেখা মাত্রই বুঝে যান কে কেমন আছি। এমন একজন মানুষ ছিলেন সাইদুল আনাম টুটুল। কাজে, আদর্শে কাছের মানুষ। টুটুল ভাইকে সত্যি মিস করবো। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াত সাইদুল আনাম টুটুলের একটি ছবি পোস্ট করে তাঁর ফেসবুকে লেখেন, মন কান্দে তাহার লাগিয়ারে….।
চলচ্চিত্র সমালোচক ফাহমিদুল হক লেখেন, ‘টুটুল ভাইও চলে গেলেন! চলচ্চিত্রবিষয়ক নানান সভায়, জুরির কাজের সহকর্মী হিসেবে টুটুল ভাইকে কাছ থেকে দেখার কিছুটা সুযোগ হয়েছিল। সজ্জন, নরম স্বভাবের এই সৃজনশীল মানুষটির জন্য তীব্র শোক অনুভব করছি।’
একটি অনলাইনে ‘প্রিয়বরেষু টুটুল ভাই’ ভাই শীর্ষক একটি আবেগঘন লেখা লিখেছেন নির্মাতা ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব শবনম ফেরদৌসী। এই লেখায় তিনি ব্যক্ত করেছেন নির্মাতা ও শিক্ষক সাইদুল আনাম টুটুলের সঙ্গে তাঁর নানা স্মৃতি।
সাইদুল আনাম টুটুলের মৃত্যুতে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংগঠক ও নির্মাতা বেলায়েত হোসেন মামুন তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে আবেগঘন এক অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। তিনি লিখেন, ‘কী নিদারুণ এক মাস এটা! আনোয়ার ভাইয়ের স্মরণসভায় আনোয়ার ভাইকে স্মরণ করলেন ৫ ডিসেম্বর। আজ ১৮ ডিসেম্বর চলে গেলেন চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সাইদুল আনাম টুটুল…! বিদায় টুটুল ভাই…।’
সাইদুল আনাম টুটুলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ডিরেক্টরস গিল্ড, বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশসহ দেশের চলচ্চিত্র সংসদগুলো। শোক জানিয়েছে বাংলাদেশে ফিল্ম আর্কাইভ ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভেশন ইনস্টিটিউট।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন এক ফেসবুক স্টাটাসে সাইদুল আনাম টুটুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আবারও শোকবার্তা লিখতে হচ্ছে। আধিয়ার চলচ্চিত্রের নির্মাতা সায়েদুল আনাম টুটুল আর নেই। ক্লান্ত হয়ে গেছি, জানি না আর কত শোক বার্তা লিখতে হবে। টুটুল ভাই আপনার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের কোর্স সমন্বয়ক জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা তাঁর ফেসবুক স্টাটাসে লেখেন, ‘আমি আর বারি স্যার বৃহস্পতিবার অফিসে বসে চা খাচ্ছিলাম, তখন টুটুল স্যার এসে বল্লেন কি ব্যাপার চা চক্র চলছে, আমি হেসে বললাম স্যার আপনার জন্য বিস্কুটও আছে। স্যার যখন চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছিলেন তখন বল্লেন দাঁত সব বাঁধাতে দিয়েছি। অনেক কথার পর চলে যাবার সময় আমি বললাম স্যার নেক্সট সেমিস্টারে মেনটর হতে হবে। স্যার এর শেষ কথা ছিল ঠিক আছে। ঠিক তো থাকলো না কিছু।’
১৯৫০ সালের ১ এপ্রিল পুরান ঢাকায় জন্মেছিলেন নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল। ১৯৬৭ সালে সরকারি মুসলিম স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ৬ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ সমরে লড়াই করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯৭৪ সালে ভারতের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে চলে যান পুনের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। সেখানে চলচ্চিত্র সম্পাদনার উপর পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৭৯ সালে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের সম্পাদনা করেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্র সম্পাদক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়া তিনি সালাউদ্দিন জাকী নির্মিত ঘুড্ডি, শেখ নেয়ামত আলী নির্মিত দহন, মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত দীপু নাম্বার টু-সহ বহু সিনেমার সম্পাদক ছিলেন।
২০০৩ সালে সরকারি অনুদানে নির্মিত সাইদুল আনাম টুটুলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আধিয়ার’ মুক্তি পায় । ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেয়ে ‘কালবেলা’ চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই কাজের ১০ ভাগ কাজ অসম্পূর্ণ রেখে পাড়ি জমান পরপারে।
বৃহস্পতিবার সকালে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে নেওয়া হবে তাঁকে। এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে বুদ্ধিজীবী করবস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তিনি।