বিশেষ প্রতিবেদক :
বসন্ত উৎসবে মেতেছে দেশ। প্রকৃতির সাথে সাথে বাসন্তী রঙে সেজেছে শহরবাসী। এ শহরে বহু বছর থিয়েটার করেছেন কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ন ফরিদী। অভিনয়ের দীর্ঘসময় পার করেছেন। বসন্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন বন্ধু-বান্ধব আর শুভাকাঙ্খীদের নিয়ে। ভালোবেসেছেন প্রকৃতি ও মানুষকে। সবার ভালোবাসার মানুষ কিংবদন্তী শিল্পী হুমায়ুন ফরিদীর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পাড়ি জমান পরপারে। ফরিদীকে ছাড়াই কেটে গেছে তাঁর প্রিয় মানুষদের ৭টি বসন্ত। এই দিনে গুনী অভিনয়শিল্পী হুমায়ূন ফরিদীর প্রতি কালচারাল ইয়ার্ড পরিবারের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
হুমায়ুন ফরীদিকে স্মরণ করে বিএফডিসিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। বাদ আসর বিএফডিসিস্থ আটিষ্ট স্টাডি রুমে এ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত আছেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীসহ চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান, প্রশংসিত ও জনপ্রিয় অভিনেতাদের একজন হুমায়ুন ফরীদি। ঢাকা থিয়েটারের মঞ্চনাটক ‘ভূত’ এর মঞ্চায়নের সময় ফরীদি পরিচালক হিসেবে প্রথম মঞ্চের সাথে জড়িয়ে যান। এরপর আর থেমে থাকার কোনো গল্প নেই তার জীবনে। এমনকি নাট্যশালার দুঃসময়েও তিনি মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজের মঞ্চে নাটকের মঞ্চায়ন চালাতে থাকেন। শকুন্তলা, কীর্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, ফণি মনসার মতো মঞ্চনাটকগুলোতে অভিনয় করে খুব দ্রুতই তিনি অনেক প্রশংসা আর জনপ্রিয়তা কুড়ান। সেই সাথে জড়িয়ে যান নাট্যদল ফেডারেশন, গ্রাম থিয়েটারের মতো দেশের প্রথম সারির অনেক নাট্য সংগঠনগুলোর সাথে। ফরীদির জীবনের এর পরের পর্বটাই তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। এরপরই তার অভিষেক ঘটে টেলিভিশনের পর্দায়। টেলিভিশনে আসার পরই নাটক আর সিনেমার মাধ্যমে তিনি আজ শহর থেকে গ্রামে প্রত্যেক বাংলাদেশীর কাছে হয়ে আছেন এক পরিচিত মুখ।
‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মাধ্যমে অসাধারণ এই অভিনেতার পর্দায় অভিনয়ের যাত্রা শুরু হয়। এরপর আর থেমে থাকা নয়। ১৯৮২ সাল থেকে পর্দায় অভিনীত নাটকের তালিকায় যোগ হয় আরও অনেক নাম, যার মধ্যে আছে ‘নীল নকশার সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কত দূর’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘মহুয়ার মন’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮), ‘কোথাও কেউ নেই’ (১৯৯০), ‘সমুদ্রের গাংচিল’, ‘তিনি একজন'(২০০৫), ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘মোহনা’, ‘ভবের হাট’ এবং ‘আরমান ভাই দ্য জেন্টলম্যান’ (সর্বশেষ নাটক) এর মতো সচরাচর ধারা থেকে ভিন্ন, অসামান্য আর বিপুল জনপ্রিয় সব নাটক। এতো নাটকের ভিড়েও সংশপ্তকে ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে তার মোহনীয় অভিনয় এ দেশের দর্শকদের মনে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে।
নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ের এই রাজার টেলিভিশনের পর্দায় অভিষেক ঘটলেও শুধুমাত্র তাতেই তিনি নিজেকে বন্দী রাখেন নি কখনো। চলচ্চিত্রের জগতেও তিনি রেখে গেছেন নিজের অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে তাঁর খলনায়কের অভিনয় শহরের সীমানা পার করে গ্রামের দর্শকদের মনেও স্থায়ী স্থান দখল করে। ‘দহন’, ‘সন্ত্রাস’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘ত্যাগ’, ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘দূরত্ব’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতো বাণিজ্যিক সিনেমার মাধ্যমে তিনি শহরের পাশাপাশি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর পাশাপাশি তার ঝুলিতে আছে ‘হুলিয়া’, ‘ব্যাচেলর’, ‘মাতৃভা’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আহা!’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামলছায়া’র মতো অনন্য সব চলচ্চিত্র। ‘মাতৃভা’তে অভিনয়ের জন্য ২০০৪ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে তিনি অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের অভিনয় বুঝতে ও শিখতে সাহায্য করেন।
হুমায়ুন ফরীদি পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার ঢাকার নারিন্দায় ১৯৫২ সালের ২৯ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম এটিএম নুরুল ইসলাম এবং মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। বাবার চাকরির সুবাদে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। মাদারীপুরের ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯৭০ সালে তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নে ভর্তি হন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য সেখানে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। দেশের জন্য যুদ্ধের পরম দায়িত্ব সম্পন্ন করে ফিরে এসে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেখান থেকেই অভিনয় ও সাংস্কৃতিক পথে তার যাত্রার শুরু। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই ছিলো তার অভিনয়ের পীঠস্থান, প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সেলিম-আল-দ্বীনের সংস্পর্শে এই ক্যাম্পাসে তার দিনগুলোই ছিলো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার দিন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য উৎসবে সবচেয়ে অগ্রগামী আয়োজক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে এই জগতে তিনি নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করেন। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ধানমন্ডির বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এই অভিনেতার ব্যক্তি জীবনের গল্পটা তাঁর কর্মজীবনের সাফল্যের মতো ঠিক অতটা সুখকর ছিলো না। তার প্রথম স্ত্রীর নাম নাজমুন আরা বেগম মিনু। ১৯৮০ সালে তারা দুইজন গাঁটছড়া বাঁধলেও চার বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে তাদের ঘর ভেঙে যায়। শারারাত ইসলাম দেবযানী নামে এই দম্পতির এক কন্যা সন্তান আছে। এরপর তিনি সহকর্মী এবং বাংলাদেশের অভিনয়ের জগতের আরেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র সুবর্ণা মোস্তফার সাথে সেই একই বছর ঘর বাঁধলেও ২০০৮ সালে অনেক তিক্ততার মধ্য দিয়ে তাদের সে ঘর ভেঙ্গে যায়।