শাহেদ নূর :
আজ ৭ মার্চ। এদিন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালিকে দিয়েছিলেন পথের দিশা। তাঁর এই ভাষণে ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। আর এই ঐতিহাসিক ভাষণ আজকে বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। লাখো লাখো মানুষ আজও তাঁর এই ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়। ৪৮ বছর পরও সেই বলিষ্ট কন্ঠস্বর ও স্পষ্ট ভিজ্যুয়াল আমাদের উদ্দীপ্ত করে। ঐতিহাসিক সেই ভাষণের অডিও ও ভিজ্যুয়াল সংরক্ষণে চলচ্চিত্র ও বেতারের রয়েছে প্রধান ভূমিকা। সেদিনকার সেই বৈরী পরিবেশে এই ভাষণ ধারণ করা ছিলো খুবই কঠিন। পরবর্তীতে এই ভাষণের বিশ্বব্যাপী প্রামাণ্য দলিল হিসেবে উপস্থাপনেও চলচ্চিত্র বিভাগের ভূমিকা রয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার সেইদিনের রেসকোর্স ময়দানে বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এখন অডিও, ভিডিও এবং মুদ্রিত রূপে আমরা পাই। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ব্যাপক কোনো প্রস্তুতি নিয়ে অভিও-ভিডিও করা যায়নি। কারণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঢাকা বেতার থেকে সরাসরি প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপে তা সেদিন প্রচার বন্ধ রাখা হয়। এর চিত্রধারণে দেওয়া হয় বাধা। তবে বেতার, ডিএফপি ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভাষণের অডিও ও ভিডিও পৃথকভাবে রেকর্ড করা হয়। এই রেকর্ড প্রচারের দাবিতে রেডিও পাকিস্তানের বাংলাদেশী কর্মকর্তারা কর্মবিরতি পালন করেন। তাদের কর্মবিরতি থেকে ফেরাতে তৎকালীন সরকার ৮ মার্চ সকাল সাড়ে 8টায় ভাষণটি রেডিও পাকিস্তানে প্রচার করতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ সালের ৮ মার্চ যে ৮-১০ জন কর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন তাদের একজন ছিলেন আশফাকুর রহমান খান। তিনি সেসময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সংগঠক।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সংক্রান্ত আরও খবর :
⇒ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন
⇒ আমার চিত্রকল্পে বঙ্গবন্ধু
৭ মার্চের ভাষণ ভিডিওতে ধারণের চেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করতে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচএম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভাষণ ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করেন ডিএফপির কর্মকর্তা অভিনেতা (মরহুম) আবুল খায়ের। মঞ্চের একপাশে ভিডিও ক্যামেরায় চিত্র ধারণ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। তবে ক্যামেরা বড় হওয়ায় এবং ক্যামেরাম্যানের নড়াচড়া করা সম্ভব না হওয়ায় একটা দূরত্বে অবস্থান নিয়ে একই জায়গা থেকে বক্তৃতার দৃশ্য যতটুকু সম্ভব ধারণ করেন আবুল খায়ের। পরে দেখা যায় ১০ মিনিটের বক্তৃতার ভিডিও রেকর্ড হয়েছে।
চলচ্চিত্র শাখার কর্মকর্তা মহিব্বুর রহমান খায়ের (প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের), আমজাদ আলী খন্দকার, জিজেডএমএ মবিন, এমএ রউফ ও এসএম তৌহিদ বাবুর সাহসী প্রচেষ্টায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অডিও-ভিডিও ধারণ করা সম্ভব হয়।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ভাষণের ৫০০টি রেকর্ড ইন্দিরা রোডস্থ অফিসের নিচে বস্তায় যত্ন সহকারে মাটিতে পুঁতে রাখেন। চলচ্চিত্র বিভাগের তৎকালীন পরিচালক/কম্পট্রলার মহিব্বুর রহমান খায়ের ভাষণের মূলকপি ও অডিও রেকর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেন। এপ্রিল মাসের শুরুতে এসব গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ ও অন্যান্য ডকুমেন্ট ৪২ ইঞ্চি মাপের একটি স্টিলের ট্রাংকে নিয়ে তিনি সহকারী চিত্রগ্রাহক আমজাদ আলী খন্দকারকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।
তার নির্দেশে আমজাদ আলী খন্দকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ভাষণের অডিও-ভিডিও ফুটেজসহ স্টিলের ট্রাংকটি বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বেবিট্যাক্সিতে করে সোয়ারিঘাটে যান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কড়া টহলের মধ্যেও আমজাদ আলী খন্দকার জিঞ্জিরা হয়ে মুন্সীগঞ্জের জয়পাড়ায় মজিদ দারোগা বাড়িতে ট্রাংকটি নিয়ে যান। এর পেছন পেছন চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক মহিব্বুর রহমান খায়েরও সেখানে যান। তারা ভাষণের রিল ও অন্যান্য ডকুমেন্টভর্তি ট্রাংকটি অত্যন্ত গোপনে সেখানে লুকিয়ে রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখান থেকে ট্রাংকটি এনে আবার অফিসের স্টোরে সংরক্ষণ করা হয়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা ৭ মার্চের ভাষণের রিল নষ্ট করার লক্ষ্যে চলচ্চিত্র বিভাগে তল্লাশি চালায়। চলচ্চিত্র শাখার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ভাষণের মূল পিকচার নেগেটিভ ও সাউন্ড নেগেটিভসহ অন্যান্য ফুটেজ ভিন্ন একটি ছবির ক্যানে ঢুকিয়ে ফিল্ম লাইব্রেরিতে লুকিয়ে রাখেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ৭ মার্চের ভাষণ মনে করে অন্য রিল নষ্ট করে আশ্বস্ত হয় যে ভাষণটি বিনষ্ট হয়েছে। এভাবেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ধারণের স্মৃতিবাহী শব্দধারণ যন্ত্র বা নাগ্রা মেশিন এবং টু-সি ক্যামেরাটি এখনও চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে সংরক্ষিত আছে।
এদিকে সরকারের সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন দায়িত্বপালনকালে ৭ মার্চের ভাষণ ও এর ইতিহাস সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। তিনি ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ২০১৫ সালে ইউনেস্কোতে প্রস্তাব পাঠান। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খানও সে সময় ইউনেস্কোতে পৃথক একটি প্রস্তাব পাঠান। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে পরামর্শ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম দালিলিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন প্রস্তাব পাঠায়। এ সব প্রস্তাব দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।