জাহিদ হাসান
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ প্রিমিয়ার শো’তে দেখা হয়েছিলো। কারণ সমকালীন দেশীয় ফিচার ফিকশন সিনেমার বিবেচনায় এ সিনেমার ট্রেইলারটি প্রমিসিং মনে হয়েছিলো। ‘সব মানিকের জন্যে স্কুল চাই’ এনজিও মার্কা স্লোগানের, মুক্তিযুদ্ধ আর শিল্প শিল্প ব্রাদারহুড কোটার বাইরে গিয়ে এমন একটা বিষয় এবং চরিত্র নিয়ে নির্মিত সিনেমার ট্রেইলারটির মধ্যে একটা অ্যাংগার দেখা গিয়েছিলো, যা আমাকে টেনেছে। সেই হেতু এ সিনেমার অপেক্ষায় ছিলাম।
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ তে দেখা যায় চিন্তা-ভাবনা করে ডেভেলপড করা পূর্নাঙ্গ একটা স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্টের চরিত্রগুলোও ডেভেলপড, দৃশ্যগুলা ইন্ডিভিজ্যুয়ালি ডেভেলপড আর দৃশ্য থেকে দৃশ্যের ট্রানজিশন আছে। সিনেমার চরিত্র মাথায় রেখে অভিনেতার চেহারা আর দৈহিক গঠন দেখে কাস্ট করার একটা নিয়ম আছে, যাকে টাইপেজ বলা হয়। যে কারণে এক্সট্রা হিসেবে কাজ করা অভিনেতাকে সত্যজিত রায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ তে চৌকিদারের ভুমিকায় নামালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ধাঁধায় পড়ে যায়, বাস্তবের কোন চৌকিদারকেই ধরে সিনেমায় বসিয়ে দিয়েছে! ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ তে অভিনেতা নির্বাচনে এই টাইপেজ ধারনা প্রয়োগের চেষ্টা বুঝা যায়; কিছু চরিত্রের ক্ষেত্রে সফলও। চরিত্রানুযায়ী পোষাকেও ভাবনা ধরা পরে । অভিনয় মোটামুটি রিয়ালিস্টিক। সিংক সাউণ্ডটা যদি এদেশে করা যেতো! সচেতনভাবে খেয়াল করলে ভয়েসে সাবলিলতার সূক্ষ অভাব আর সচেতন কন্ঠ ধরা পরে।
বিষয় মাথায় রেখে সিনেমাটোগ্রাফিতে যে ব্লিক একটা টোন দেয়া হয়েছে, তা সামগ্রিকভাবে মানিয়ে গেছে। লো কন্ট্রাস্ট লাইটে খেয়াল না করলে রাত নাকি দিন তা দর্শকের চোখ এড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, দিনের বেলায় বড় এরিয়া এক্সপোজ হলেও সূর্যের আলোয় গাড়ির ভিতরে-বাইরে হাই লাইট লো লাইটের পার্থক্য চোখে না পড়ায় ধরে নেয়া যায় পরিকল্পিতভাবে দিনের বিশেষ সময়ে শ্যুট করা হয়েছে। ভালো লেগেছে এডিটিং, শটের পরে শট, ৩-৪ টা শটে একটা বিষয়কে স্মার্টলি তুলে আনা, ট্রানজিশনে সাউণ্ডে হঠাৎ ধাক্কায় নয়েজ থেকে সাইলেন্স, সাইলেন্স থেকে নয়েজে যাওয়া।
হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদঘাটন, কিন্তু উদঘাটন দার্শনিকের মতো নয়। যা উদঘাটিত হল- তা যে-কোন জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্যের রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয়, তাহলে উদঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরোনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি…. কিন্তু তা কবিতা হল না, হল কেবল মনোবীজরাশি। কবিতার কথা-জীবনানন্দ দাশ
সমস্যা হলো জনগণ সিনেমার ক্যারেক্টারের ‘আমি কোন নবী রাসুল না’ ডায়লগটাকে মাথায় নিয়ে পরিচালককে বাংলা চলচ্চিত্রের পরিত্রাণকারী আর মহান চলচ্চিত্র নির্মাতার ইঙ্গিত যেভাবে দিচ্ছে পরিচালক নিজে লজ্জা পাবে। কয়েক যুগ ধরে কুয়ার ব্যাং এর পুরস্কার পুরস্কার খেলা সিনেমার থেকে আলাদা হতে পেরেছে ঠিক, কিন্তু বিশ্ব চলচ্চিত্রের সারিতে জায়গা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি বলেই মনে করি। ভবিষ্যতেও যাতে না হতে পারে এই দেশীয় কুয়াতে ফেলে, সেই রাস্তা বন্ধ করবেন না প্লিজ। সীমাবদ্ধ উদ্দেশ্য-কৌশল-চেষ্টায় পরেনি বলেই ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ নির্মাণ করতে পেরেছে।
নব্বইয়ের দশকের কলকাতার মেইনস্ট্রিমের ‘একটু হরলিক্স দাওনা চেটে চেটে খাবো’র গল্পের থেকে খুব বেশি দূরের গল্প এটা না। মোড়কটা নতুন আরেকটু বাস্তবিক। সিনেমার টেকনিকে আয়ত্ত আছে, কিন্তু সার্ফেস ভেদ করে খুব ভেতরে এই সিনেমা যেতে পারেনি। এই শহরে যার এক পা খুড়ো নয়, যার শেয়ারে টাকা লস হয় নাই, গ্যাঞ্জামে যার গাড়ি পুড়েনি, যার গার্লফ্রেন্ড প্রেগন্যান্ট হয়নি, যার ভাই ড্রাগ ওভারডোজ হয়ে মারা যায়নি, যে টাকা ঋণ শোধ না করতে পেরে পিটুনি খায়নি, সে কোন বেহেশতেটায় আছে এই শহরে? এই সময়ে দাঁড়িয়ে অতি-ট্রাজিক বিষয়টা সিনিকাল না হলে উৎরাতে পারেনা। সত্যের লেয়ার অনেক ভেতরে, সেখানে পৌঁছাতে হাঁটা নিশ্চিত করাই হোক প্রধান উদ্দেশ্য।