নিজস্ব প্রতিবেদক :
আন্তর্জাতিকমানের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সিনেমাটোগ্রাফার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনির ২০১১ সালের ১৩ই আগস্ট একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। যাদের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক মানে, সর্বপ্রথম বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম বড় আসর কান চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রের কারিগরদের প্রয়াণের ৮ বছর পেরুলো আজ। পুরো জাতির সঙ্গে কালচারাল ইয়ার্ড স্মরণ করছে চলচ্চিত্রের এই দুই নক্ষত্রকে।
২০১১ সালের আজকের এ দিনে তারেক মাসুদ তাঁর নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর জন্য লোকেশন দেখতে স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নয় সদস্যের একটি দল নিয়ে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলেন। তাঁদের বহনকারী মাইক্রো বাসের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর ছাড়াও চালক মুস্তাফিজ, তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। ওই দুর্ঘটনায় আহত হন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম জলি।
২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নির্মাতা তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানকে সম্মান জানায়।
এই দুর্ঘটনায় হওয়া মামলায় বাস চালককে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও সাত বছর আগের এই মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি এখনও হয়নি। প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাসচালকের আপিল এখন হাইকোর্টে শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে। এছাড়া নিহত দুই পরিবারের পক্ষ থেকে মোটরযান অধ্যাদেশের বিধান অনুসারে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আলাদা দু’টি মামলা হয়। এর মধ্যে তারেক মাসুদের পরিবারের করা মামলায় হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দিয়েছেন। এই রায়ের পর বাস-মালিকপক্ষ ও বাদীপক্ষ আলাদা লিভ টু আপিল করেছে, যা আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষায় আছে। অন্যদিকে মিশুক মুনীরের পরিবারের পক্ষ থেকে করা ক্ষতিপূরণ মামলা সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে।
এ বছর ঈদ উপলক্ষে কোন জায়গায় সেভাবে তাদের মৃত্যুবার্ষিকীরে আয়োজন হয়নি। তবে আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি এবং তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট যৌথভাবে তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকীর আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছেন ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়াত হোসেন মামুন।
প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করে অভিনেত্রী ও নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী ও নির্মাতা আবু সাইয়ীদ গত বছর কথা বলেছিলেন চ্যানেল আইয়ের তারকা কথন অনুষ্ঠানে। তাদের কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
তাঁকে স্মরণ করে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেছিলেন, তারেক ভাইয়ের সাথে সাথে আরেক জনের কথা আমাদের কিন্তু বলতেই হবে, তিনি ক্যাথরিন মাসুদ। তারেক ভাই যা ভাবতেন, ক্যাথরিন সেটা এক্সিকিউট করতেন। তারা চিলেন যুগলবন্দি। এই দুজন মানুষ মিলে চলচ্চিত্রের একটা নতুন পৃথিবী তৈরি করেছিলেন। তারেক ভাইয়ের অনেক কাজ হয়তো এখনই বাস্তবায়ন করতে পারছে ক্যাথরিন, কিন্তু তারেক ভাইয়ের রেখে যাওয়া অনেক কাজ কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি সম্পূর্ণ করেছেন।
আশা করি ভবিষ্যতে তারেক ভাইয়ের সব স্বপ্ন সফল করতে পারবেন। তিনি বলেন, তরুণ নির্মাতাদেরকে নানা ভাবে সহায়তা করতেন তারেক মাসুদ। আমি উনার সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে সম্পর্কটা বা আদর্শিক জায়গাটা শুধুমাত্র কাজ বা নির্দিষ্ট কোন ছবি কেন্দ্রিক তা না, নির্দিষ্ট ছবি ছাড়াও পুরো বাংলাদেশের যে ফিল্ম বা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সেটা নিয়েও তারেক ভাইয়ের সাথে আমাদের আলোচনা হত। এবং উনার ভাবনার জগৎ যে শুধুমাত্র উনার নিজের ছবিকে ঘিরে ছিল তা নয়, উনি ভাবতেন পুরো চলচ্চিত্র অঙ্গন নিয়ে, উনি ভাবতেন অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মিতারা কী করছেন তা নিয়ে বা স্ক্রিপ্ট রাইটাররা কী করছেন তা নিয়ে। কীভাবে তারা স্ত্রিপ্ট লিখলে বাইরের ফান্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করা যেতে পারে বা বাহিরের অর্গানাইজেশনগুলোর সাথে এড হওয়া যেতে পারে, এগুলো কিন্তু তিনি নিজে থেকেই করতেন এবং চাইতেন দলটা ভারি হোক চলচ্চিত্র নির্মাতার।
নির্মাতা আবু সাইয়ীদ বলেছিলেন, আমি একটা মাদ্রাসা পড়া গ্রামের ছেলে। যার ছোটখাটো মাদ্রাসায় আজান দেয়ার কথা অথবা মৌলবি হওয়ার কথা ছিলো। অথচ যে দুর্ভাগা দেশে সিনেমার কোনো স্কুল নেই সে দেশে আমি সিনেমা বানাচ্ছি। আমি সৌভাগ্যবান নই, তো কে সৌভাগ্যবান?- কোনো ধরনের অসচ্ছতার আশ্রয় না নিয়ে প্রতিনিয়ত এভাবেই নিজের অবস্থান, নিজের দেশ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনায় ডুবে থাকতেন যিনি তিনি তারেক মাসুদ।
তিনি বলেন, তারেক মাসুদের কাজ কর্মের সাথে নিবির যোগাযোগ ছিলো এই দুই নির্মাতা ও অভিনেত্রীর। নির্মাতা আবু সাইয়ীদ ছোট ভাইয়ের মতো হলেও তারেক মাসুদ তাকে বন্ধুর চোখেই দেখতেন। এমনকি আবু সাইয়ীদ যখন সিনেমা নির্মাণ করেন, তখন তারেক মাসুদ তাকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেন।
কথার ফাঁকে তারেক মাসুদের স্ট্রাগল জীবনের কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, এই সময়ে এসে তারেক মাসুদের ব্যক্তিগত স্ট্রাগলের গল্প বলা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ জানি না, তবু বলি। আমরা তখন একসাথে অনেকেই। হোটেল গাবতলী নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। সেখানে আমরা কয়েকজন দুপুরের খাবার খেতাম ১৩ টাকা দিয়ে। এটা ছিলো আমাদের নিয়মিত রুটিন। এরচেয়ে বেশি খরচ করার মতো সামর্থ তখন আমাদের কারো ছিলো না। এখানে যারা ছিলাম তাদের কারোরই কিন্তু আর্থিক দৈন্যতা থাকার কথা ছিলো না। আমরা যদি ফিল্ম বাদ দিয়ে অন্যকিছু করতাম তাহলে এমনটি তখনও কারো হতো না। সিনেমা করবেন বলে এই কৃচ্ছতা সাধন যারা করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম একজন ছিলেন তারেক মাসুদ। অনেক পরে এসে হয়তো ফিল্ম নিয়ে একটু স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করেছেন, কিন্তু তারেক মাসুদ সারা জীবন স্ট্রাগল করে গেছেন সিনেমার জন্য।
তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ দেশে ও বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ‘মুক্তির কথা’ এবং চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে নির্মিত ‘আদম সুরত’ এর কারণেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। শহীদ বুদ্ধিজীবি মুনীর চৌধুরীর ছেলে আশফাক মিশুক মুনীর। ক্যামেরা ডিরেক্টর হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। মিশুক মুনীর নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসির ভিডিও গ্রাহক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করা মিশুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতাও করেছেন। তারেক মাসুদের ছবি ‘রানওয়ে’র প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন তিনি।