বিশেষ প্রতিবেদক :
গত আগস্টে কালচারাল ইয়ার্ডের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন। সে সময় তিনি বলেছিলেন: ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকে আমি সবসময় বলি এটি জাতীয় চলচ্চিত্র তিরস্কার। কারণ প্রতি বছরই এ পুরস্কার যে বিচারে দেয়া হয় সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। বন্টন প্রক্রিয়ায় এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ’ প্রতি বছরই এ পুরস্কার বিতর্কের জন্ম দেয়। এবারও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ২০১৭ সালের জন্য ২৭টি বিভাগে ও ২০১৮ সালে ২৮টি বিভাগে বিশিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ প্রদানের ঘোষণা করে তথ্য মন্ত্রণালয়। এরপর বরাবরের মতো আবারও বিতর্ক উঠে এ পুরস্কার নিয়ে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা এ পুরস্কারের নানা দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
এবারে যে বিতর্ক জন্ম নেয় তা হলো ‘ঢাকা অ্যাটাক’ চলচ্চিত্রের সম্পাদনার জন্য মো. কালামকে পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ভারতীয় নাগরিক। বিধান অনুযায়ী বিদেশী কোন নাগরিককে চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া যায়না। এছাড়া ‘কৌতুক অভিনেতা’ বিভাগে মোশাররফ করিমকে কমলা রকেট চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এ চরিত্রটি কোন কৌতুক অভিনেতার চরিত্র নয় বলে জানান মোশাররফ করিম। এ ছবির লেখক ও চিত্রনাট্যকার শাহদুজ্জামানও জানিয়েছেন তিনি কৌতুক চরিত্রের জন্য এ চরিত্রের সৃস্টি করেন নি।
এ ধরণের বিতর্ক এবারই প্রথম নয়, এর আগেও প্রায় প্রতিবারই এ পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়। তাই বরাবরের মতো এবারও ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যটাস লিখেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কার্যত ‘তিরস্কার’ ছাড়া আর কিছু নয়; এ কেমন করে পুরস্কার হয়, তা বোঝা মুশকিল; পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাজে কোনো রকম শ্রেষ্ঠত্ব, তো দেখতে পাই না। তবে এর জুরিরা কী দেখে এসব কাজকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ স্বীকৃতি দিচ্ছেন? পুরস্কার দেওয়ার জন্য কাজ না পেলে পুরস্কার দেবেন না, সেটাও তো ভালো একটি দৃষ্টান্ত…।
চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার একটি সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। তবে এ স্বীকৃতি নিয়ে বিতর্ক কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু সেটিই ঘটে চলেছে। এর আগে ২০১৬ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য ছবিটির প্রযোজক ও পরিচালক মুরাদ পারভেজকে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার দেওয়া হয়। পরে জানা যায় ছবিটি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘গাছটা বলেছিল’ গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে গল্পকারের কোন স্বত্ব বা অনুমোদন না নিয়েই। এ নিয়ে লেখকের বড় ছেলে অভিজিৎ সিরাজ। এরপর বিতর্কের মুখে ছবিটিকে বাদ দেয়া হয়।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সংক্রান্ত আরও খবর :
⇒ যাঁরা পেলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার
⇒ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ২৮ ছবি
আবু শাহেদ ইমন পরিচালিত সিনেমা ‘জালালের গল্প’ দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়। ছবিটি অবলীলায় ২০১৫ সালের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেতে পারত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে এ ছবির মেকাপম্যানকে পুরস্কার দেওয়া হয়। ব্যাপারটা অবাক করার মধ্যেও হাস্যকর ঠেকেছে এ ছবির পরিচালক থেকে কলাকুশলী সবার মধ্যে। কারণ যে ছবিতে মেকাপম্যান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় সেই ছবিতে তেমন কোনো মেকাপ-ই ব্যবহার হয়নি! ছবিতে শুধু তৌকির আহমেদের গোঁফটা লাগিয়েছে। আর ঘাম মুছে দিয়েছে। এদিকে মেকাপম্যান সেটে মাত্র ৪দিন গিয়েছে। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে পরে তৌকির আহমেদের গোঁফ ফেলে দিতে হয়েছে ছবির একপর্যায়ে। শুধু একটি গোঁফ লাগিয়েই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়ায় হাস্য্যরসের সাথে অবাক ও ব্যাথিত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। শুধু এ বিষয়গুলোই নয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমনা ছবির জন্য পুরস্কার না দিয়ে কিছুটা সমানুপাতিকহারে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ধরণের বিতর্ক প্রতি বছর লেগে থাকায় প্রশ্নও উঠেছে এখানে জুরি হচ্ছেন কারা?
এবারের ২০১৭ ও ২০১৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে কমলা রকেটে অভিনয়ের জন্য জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিমকে কৌতুক অভিনেতার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে উস্মা প্রকাশ করেছেন মোশাররফ করিমসহ ছবিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সবাই। এমনকি দর্শকমহলেও উঠেছে সমালোচনার রব।
মোশাররফ করিম তাকে দেওয়া পুরস্কারটি প্রত্যাহ্যার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ নিয়ে তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে তিনি লিখেছে, ‘সকলের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, গত ৭ নভেম্বর দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষনা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় আমি নিজের নামও দেখতে পেয়েছি। নুর ইমরান মিঠু পরিচালিত ‘কমলা রকেট’ চলচ্চিত্রের জন্য আমাকে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কৌতুক চরিত্রে’ পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। ধন্যবাদ সংশ্লিষ্টদের।’
তিনি জানান, ‘কিন্তু এই পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে আমার কিছু কথা রয়েছে। তার আগে সবাইকে অবগত করতে চাই, কৌতুকপূর্ন বা কমেডি চরিত্র আমার কাছে অন্যসব চরিত্রের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘কমলা রকেট’ চলচ্চিত্রে আমি যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছি সেটি কোনোভাবেই কমেডি বা কৌতুক চরিত্র নয়। ছবিটির চিত্রনাট্যকার, পরিচালকসহ সহশিল্পীরা নিশ্চয় অবগত আছেন। একই সঙ্গে যারা ছবিটি দেখেছেন তারাও নিশ্চয় উপলব্ধি করেছেন ‘কমলা রকেট’ এ আমার অভিনয় করা ‘মফিজুর’ চরিত্রটি কোনো কৌতুক চরিত্র নয়। এটি প্রধান চরিত্রগুলির একটি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে জনপ্রিয় এই অভিনেতা লিখেন, ‘তাই, সন্মানিত জুরি বোর্ডের কাছে আমার অনুরোধ, ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কৌতুক চরিত্রে’ আমার জন্য বরাদ্দ করা পুরস্কারটা প্রত্যাহার করে নিলে ভালো হয়। না হলে আমার পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করা সম্ভব নয়।’
সবাইকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও লিখেন, ‘আমি কাজটাকে ভালোবেসে আমৃত্যু কাজ করে যেতে চাই। আমার ভক্ত, শুভাকাঙ্খিসহ সকলের কাছে আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া চাই। একই সঙ্গে যারা পুরস্কার পেয়েছেন সবাইকে অভিনন্দন জানাই। ’
সবশেষে নোট আকারে মোশাররফ করিম লিখেন, ‘এই মুহুর্তে আমি ব্যক্তিগত কাজে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। তাই লিখিতভাবে সবাইকে জানানো হলো। আশা করছি পরিস্থিতিটি বুঝতে পেরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
২০১৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ফজলুর রহমান বাবুকে ‘গহীন বালুচর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা’ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এ নিয়েও মুখ খুলেছেন বাবু। তিনি বলেছেন, ‘“গহীন বালুচর” ছবিতে আমার ব্যতিক্রম চরিত্র ছিলো। তবে আর যা-ই হোক, সেটি কৌতুক চরিত্র না। খলচরিত্র বলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই কৌতুক চরিত্রকে ছোট করে দেখছি না। ’
নির্মাতা হাসান রেজাউল ফেইসবুকে লিখেন, ‘কৌতুক অভিনেতা বাছাই করাও একটা কৌতুক।’ অনেকে মোশাররফ করিম এবং ফজলুর রহমান বাবুর নাম উল্লেখ করে লিখেছেন, তাঁদের পুরস্কার গ্রহণ করা উচিত হবে না।
এ নিয়ে প্রবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল তাঁর ফেসবুকে স্ট্যটাসে লিখেন, বাংলাদেশে সিনেমার জন্য কেউ অনুদান/ পুরস্কার ইত্যাদি পেলে খোলা মনে একটু শুভেচ্ছা অভিনন্দন এসব জানাতেও পারি না।
এরকম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে এরকমই হতাশা ব্যাক্ত করছেন চলচ্চিত্রপ্রেমী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
বেলায়াত হোসেন মামুনের উক্তির মতো বলতে হবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কি আসলে জাতীয় চলচ্চিত্র তিরস্কার হয়ে উঠছে? প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।